১৯৪৮ সাল প্রায় এক বৎসর অতিবাহিত হতে চললো ইংরেজ শাসন হইতে মুক্ত হয়ে ভারত উপমহাদেশ পাকিস্তান ও ভারত নামে দুই রাষ্ট্র হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে মাত্র। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলের।
তারিখটি মনে নেই জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়, চারিদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার জিন্নাহ সাহেব ঢাকা আসছেন। আমি আমার কয়েক বন্ধু মিলে বায়না ধরলাম ঢাকা যাবার। মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়ে আমরা কয়েকজন বড় ভাই ডাঃ কাদেও সহ সভা অনুষ্টানের দিন ঢাকা পৌছলাম। পল্টন ময়দান লোকে লোকারন্য, আমরা মঞ্চের সামনে বসে পড়লাম। বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা দিচ্ছে, হঠাৎ ঘোষণা এলো জিন্নাহ সাহেব আসছেন চারদিকে লক্ষ করলাম হেলীকপ্টার থেকে ও মঞ্চে ঢোকার দুই দিক হতে অজস্র পুষ্প বৃষ্টি শুরু হলো। জিন্নাহ সাহেব মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন। কিছুক্ষণ পর তার বক্তব্য শুরু হলো। বক্তব্যটি ছিল উর্দ্দু ও মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে। বক্তৃতার শেষ দিকে ঘোষণা হলো উর্দ্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা, ইংরেজিতে বললেন “টৎফঁ ঝযধষষ নব ংঃধঃব ষধহমঁধমব.”
হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ হলো মানি না! মানি না!! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। আমরাও সাথে আওয়াজ তুললাম “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন এক টসবগে যুবক। বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম উনি কে? ভাই বললেন উনি শেখ মুজিবুর রহমান (বর্তমান জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)।
সেদিন থেকেই শুরু হলো ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচি। প্রায় দিনই মিটিং সমাবেশ হতে লাগলো ভাষার দাবিতে। দেখতে দেখতে চলে এলো ১৯৫২ সাল। আমরাও স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছি। মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের ১ম বর্ষ বিজ্ঞানের ছাত্র। কমবেশি ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়লাম। কলেজের নির্বাচন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে বন্ধু-বান্ধব সহ সবাই জড়িত থাকতাম। ১৯৫৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ কওে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হলাম। নতুন বন্ধু-বান্ধবদেও সানিধ্য পেলাম। সে সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর সাথে আমার খুবই অন্তরঙ্গ ভাব ছিল। কারণ ইলিয়াস মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজেও পড়াশুনা করেছে। একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরতাম বিজ্ঞান বিভাগে। যদিও আমি ৫৮/৫৯ শরৎগুপ্ত রোডের বাসায় থেকে পড়াশুনা করতাম, তথাপি মাঝে মধ্যে বন্ধু বান্ধবদের আড্ডা জমাবার খাতিরে ফজলুল হক হলে থাকতাম। আর কোনরূপ উপলক্ষ থাকলে তো আর কথাই নেই। রাতভর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে গল্প গুজব ও পড়াশুনা নিয়ে আলাপ চলতো।
১৯৫২ সালে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি ছালাম, বরকত, রফিক ভাষার জন্য যে আতœহুতি দিয়ে গেছেন তার স্মরণে প্রতি ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস পালিত হয়। তাই ২০ শে ফেব্রুয়ারি ফজলুল হক হলে সারারাত আমরা জেগে বিভিন্ন ব্যানার, কাল ব্যাজ ও বিভিন্ন স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড তৈরি করলাম। বন্ধু ইলিয়াস মাঝে মধ্যে রসালো কথাবার্তা বলে আমাদেও জাগিয়ে রাখতে সহায়তা করতো। এই বন্ধুর সাথে প্রায়ই আমার বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। শেখ হাসিনাকে দেখেছি ফ্রক পড়া স্কুলের ছাত্রী হিসেবে। ভাইয়া ভাইয়া বলে আমাদের সাথে কথা বলেছে, যতদূও মনে পড়ে বড়জোড় ঠ কি ঠও এর ছাত্রী হবে। আমাদের দেখলেই বলতো কবে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। আমরা বলতাম নিশ্চয়ই পড়বে, ভাল কওে পড়াশুনা করো। বঙ্গবন্ধু সে সময় নাজিমুদ্দিন রোডে এক ভাড়া বাসায় থাকতেন।
যাই হোক রাত ১২.০১ মিনিটে হলের ছাদে কালো পতাকা উড়ানোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা হলের সব ছাত্র ছাদে উঠে কাল পতাকা উত্তোলন করলাম, শ্লোগান শুরু হলো “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই”। শহীদদেও রক্ত বৃথা যেতে দেব না, ইত্যাদি।
২১ শে ফেব্রুয়ারির প্রবাত ফেরির আয়োজন চলছে। এরই মধ্যে হল গেইটে আর্মি দেখা গেল। ছাত্র নেতা তাহা ভাই, মুহিত ভাই আরও অনেকে জোর তর্ক চলছে। ভিসি না আসা পর্যন্ত তাদেও হলে ঢুকার বাধা দেওয়া হল। তথাপি জোর পূর্বক হলে ঢুকে ছাদে গিয়ে লাথি মেওে কালো পতাকা ফেলে দেয়। সারা হল তখন স্লোগানে মুখরিত হল। আর্মিদের গালাগালি দিচ্ছিল অনেকে। আর্মিরা অনেককে মারধর করল। আমাকে সহ আমার অনেক হল মেইটকে ধরে নিযে যাচ্ছিল। এমন সময় আমাদের ভিসি গেইটে উপস্থিত হলেন। তখন ভিসি ছিলেন ড. জেঙ্কিংস (যতখানি মনে পরে)। তিনি আর্মিদের সাথে অনেক কথা কাটাকাটি করলেন, স্পষ্ট ভাষায় বললেন, আমার অনুমতি ছাড়া কেন তোমরা হলে ঢুকলে। আরও বললেন আমি বেঁচে থাকতে একজন ছাত্রকেও তোমরা নিয়ে যেতে পারবে না। পরে কয়েকজন আর্মি অফিসার নিয়ে হল অফিসে নিয়ে কোথায় যেন ফোন করলেন। তারপর আর্মিরা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ইতিমধ্যে বেশ বেলা হয়ে গেছে। অন্যান্য হল ও স্কুল কলেজ থেকে মিছিলের পর মিছিল বের হচ্ছে আমাদেও মিছিল হল থেকে বের হয়ে শহওে প্রদক্ষিণ কওে প্রায় বেলা ১২.০০ টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জড়ো হলাম (বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগ)। কিছুক্ষণের মধ্যে সভার কাজ শুরু হল। তাহা ভাই, মুহিত ভাই, হানিফ ভাই করতালী ও সেম সেম শব্দের মাঝে জোর বক্তব্য রাখছেন। হঠাৎ আর্মিও ট্রাক ঢুকলো। ছাত্রদেও মধ্যে চরম উত্তেজনা। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ছুড়ে আমাদেও বিতারিত করতে চাইল। শুরু হলো ঢিল ছোড়াছুড়ি। আমরা দোতলায় গিয়ে যে যেখানে পারলাম আশ্রয় নিলাম। একটি রুমে আমি ও আমার দুই বন্ধু ভিতওে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর্মিরা প্রতি রুমে রুমে লাথি মেরে দরজা খুলে ছাত্রদের গ্রেফতার করে নিচ্ছে। আমাদেও রুমে এসে দাড়ানোর সাথে সাথে আমরা দরজা খুলে দিলাম। “চালো ট্রাকমে উঠো”। ট্রাক থেকে দেখলাম দূরে দাড়িয়ে আমার বন্ধু ইলিয়াস আহাম্মেদ চৌধুরী, চিৎকার করে বলছে দোস্ত ঘাবরিও না আমরা শীঘ্রই তোমাদের বের করে আনবো। আমি বললাম আমার বাসায় খবর দিও ও বললো কোন চিন্তা করো না, আমি এখনি চাচা-চাচিকে খবর দেব।
সারাদিন আমাদের লালবাগ থানায় রাখা হলো। বিভিন্ন এলাকা থেকে শতশত ছাত্র-ছাত্রীদের ধরে এনে জড়ো করে তাদের নাম ও ঠিকানা লিখা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বোন জওহরত আরা (পরবর্তীতে ওয়াপদার চেয়ারম্যান ডিকে পাওয়ারের স্ত্রী), শায়েস্তা আপা, নাজমা আপা আরও অনেকে চিৎকার করে বলছে ভাইয়ারা কেউ আপোষ করবেন না। আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনাদের ছেড়ে যাব না। সবাই সাহস রাখবেন “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” শহীদদের রক্ত, শপথ নিলাম শক্ত, শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দিবো না ইত্যাদি স্লোগানে মুখর হয়ে উঠলো এলাকা।
যতদিন জেলে ছিলাম, তার বেশির ভাগ সময়ই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জন্য জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে খাবার পাঠাতেন। যেদিন খাবার পাঠাতে পারতেন না, সেদিন মোটা ভাত, ডাল ও একটা তরকারি দেওয়া হত। যার অধিকাংশই আমরা খেতে পারতাম না। সন্ধ্যা বেলা আমাদের লক-আপে যেতে হতো। ভোর হলে লক-আপ থেকে বের হয়ে সারা দিনই বাহিরে গল্প গুজব, লুডু, কেরাম খেলা ও নানান আড্ডা দিয়ে দিন কাটাতাম। আমরা যে ওয়ার্ডে থাকতাম তার কাছেই ছিল মুসলিম গার্লস স্কুল। স্কুলের মেয়েরা ছাদে উঠে আমাদের হাত নেড়ে উৎসাহ দিত এবং স্লোগান দিত “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই” তাদের এই চিৎকারে আমরা খুবই উৎসাহিত বোধ করতাম।
এমনি ভাবেই দিন কাটতে লাগলো। আমাদের বহিঃ জগতের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে খবর পেতাম বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তির জন্য সরকারের সাথে দেন দরবার করছেন। সত্যি সত্যিই একদিন সেই দিন আসলো। খবর হলো আমরা আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছি। সবাই আনন্দিত, একে অপরের সাথে কোলাকুলি করলাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম,, খুশির আবেগে।
দিনটি বোধহয় ১৯ কিংবা ২০ শে মার্চ হবে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নিজের জামা কাপড় সব গুছালাম। সবাই ম্লান করে নাস্তা খেয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম মুক্তির প্রহর গুনতে গুনতে। সেন্ট্রিরা এসে খবর দিল বাহিরে আপনাদের জন্য অনেক লোক অপেক্ষা করছে। আপনারা লাইন করে আস্তে আস্তে বের হউন। আমরা লাইন করে বের হতে শুরু করলাম। জেল গেইটে কর্মরত সেন্ট্রি ও পুলিশ কর্মচারী ও কর্মকর্তাগণ দাড়িয়ে হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানালেন। আমরাও হাত তুলে প্রতিত্তোর দিলাম। জেল গেইট পার হয়ে দেখলাম অনেক স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রী ফুলের মালা হাতে দাড়িয়ে আছে। একজন এগিয়ে এসে আমার গলায় মালা পড়িয়ে দিয়ে হাত মেলালো। কিছুদুর এগিয়ে দেখলাম আমার বড়, মেঝ, সেঝ ভাই এবং বন্ধু ইলিয়াস, সাথে ৪ বৎসরের ছোট্ট ছেলে আমার ভাইস্তা (বাবুল-আখতার) দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে সবাইকে জড়িয়ে ধরে আবেগে কেঁদে ফেললাম। ছোট্ট ভাইস্তা (বাবুল আখতার) ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় আমাকে প্রশ্ন করলো কাকু তুমি কোথায় ছিলে? আমি বললাম এই জেলের ভেতরে। বাবুল প্রশ্ন করলো কেন? আমি বললাম দেশের জন্য। উত্তরে বাবুল বললো আমিও জেলে যাব। আমি বললাম কাকু তুমি বড় হয়ে নাও।
মুক্ত পরিবেশে এসে আমার যে কি ভাল লাগছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আজ আমার ভাইস্তা বাবুল আখতার আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার সেই অবুঝ উক্তি আজও আমি ভুলতে পারছি না। “দেশের জন্য আমিও জেলে যাব”। সত্যিই সে দেশকে মনে প্রাণে ভালবেসে ছিল। আশা করি দেশবাসী তার অবদান মনে রাখবেন। দুঃখ লাগে তখনই ভাবী কোথায় গেল ভাষা সৈনিক তাহা ভাই, মুহিত ভাই, হামিদ ভাই আরও অনেকে। সরকারের চেষ্টা করা উচিৎ ভাষা সৈনিকদের খুঁজে বের করে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা।
এম.এ.খালেক, সভাপতি, বিবির বাগিচা সমাজকল্যাণ পরিষদ
বাংলাদেশ সময় ২০০০ ঘণ্টা, মার্চ ০১, ২০১৩