যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণ প্রজন্মের ডাকা শাহবাগের গণজাগরণ এখন আর শুধু প্রজন্ম চত্বরেই থেমে নেই। সেই জাগরণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে-কানাচে, প্রবাসে, সর্বত্র।
শুধু কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের প্রতিবাদে একজন একজন করে জমায়েত হওয়া শাহবাগ আজ যেন এক টুকরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। তাইতো, কাদেরের ফাঁসির দাবির সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচারাধীন সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দিয়ে বাংলার মাটিকে কলংকমুক্ত করার দাবি। তারওপরে যোগ হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে এবং স্বাধীনতার বিপক্ষের অশুভ শক্তি "জামায়াত-শিবির" নামক ইসলামের নাম ভাঙিয়ে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি।
রাজনীতির গোলকধাঁধার এই খেলায় দুর্নীতির চাপে নুয়ে পড়া আওয়ামী সরকার কিন্তু ভোল পাল্টে খুব তাড়াতাড়ি গণজাগরণের পক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়ে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। আর তাইতো সম্প্রতি জনপ্রিয়তার তলানিতে থাকা দলটি সব সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে আবারও জনসমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়েছে।
অপরদিকে গণজাগরণের পক্ষে আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট অবস্থানের পর দেশের অনেকেরই দৃষ্টি ছিল দেশের প্রধান বিরোধীদলের সিদ্ধান্তের প্রতি।
শুরু থেকেই জামায়াতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচিত বড় এই দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের গণআন্দোলনের প্রতি কেমন যেন মিনমিন সুরে কথা বলছিল। তাদের কথা এমন অস্পষ্ট যে, মুখের কাছে কান নিয়ে গেলেও কিছু শোনা যায় না, আর বোঝা তো দুঃসাধ্য ব্যাপার!!! অধিকাংশ সময় দলের কিছু নেতা কিছু অর্থহীন আবোল-তাবোল বকেই আন্দোলনের সময়টা পার করে দিয়েছিল। দলটির প্রধান, যিনি আপোসহীন দেশনেত্রী বলেই সুপরিচিত তার কাছ থেকে দলীয় প্রতিক্রিয়া জানার জন্য নিঃসন্দেহে অনেকেই উৎসুক ছিলেন।
অবশেষে আন্দোলনের তিন সপ্তাহ পর শীতনিদ্রা ভেঙে প্রতিক্রিয়া এল অনেক নাটকীয়ভাবেই। আগুনঝরা মার্চের প্রথমদিনেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে কোনও সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লিখিত “প্রেসনোট”টি কিছুটা এঁকেবেঁকে ছোটখাটো রাজনৈতিক বক্তৃতার আকারে উৎসুক জনতার কাছে পৌছে গেল। এতদিনের মিনমিনে সুরে অবোধ্য ভাষা যেন এক নিমিষেই দিনের আলোয় ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেল সবার কাছে।
আপোসহীন নেত্রী আসলেই কি আপোসহীন!! কথা দিয়েছিলেন সুখ-দুঃখে তাঁর দল জামায়াত নামক যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের দলটির পাশে থাকবেন। জনগণ, যাদের ভোটে তারা ক্ষমতা নামক আলাদীনের চেরাগ ঘষেন, সেই জনতাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে তিনি আপোসহীনভাবেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে থাকবেন সে কথাই স্পষ্ট করে দিলেন সেদিন। শাহবাগের গণজাগরণ তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দলটির অবস্থান নিয়ে বহুল আলোচিত অস্পষ্ট কানাঘুষা এখন সুস্পষ্ট।
বিএনপির মধ্যে বিরাজমান স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে থাকা সমর্থকদের এখন আর আশা করি কিছুই বলার নেই। দলের প্রধানই যখন সুস্পষ্টভাবে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নেয়, তখন দলের মধ্যে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গালে তা চপেটাঘাত নাকি ফুলের টোকা তার উত্তর তারাই জানে। তবে উত্সুক জনতা যারা আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার সমর্থক নয়, কিন্তু বুকের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা ধারণ করে তাদের গালে আপোসহীন নেত্রীর নির্লজ্জ আপোসহীনতা যে সজোরে চপেটাঘাতের ন্যায় তা বলাবাহুল্য।
সুস্থ অহিংস একটা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেওয়ার জন্য বেছে বেছে একজন নাস্তিক ব্লগারকে খুন করে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক ধর্মব্যবসায়ী দলটি। প্রথমে নীরবে জামায়াতের এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে এবং পরে সরবে আস্তিকতা-নাস্তিকতার মত স্পর্শকাতর ইস্যুটিকে উস্কে দিয়ে বিএনপি আজ সমগ্র দেশকে অস্থিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। যে অস্থির সময়ে দেশের মানুষের পাশে এসে দাড়ায় দরকার, সেই সময়কে আরও অস্থিতিশীল করে তোলার দায়ভার অবশ্যই বিএনপি-জামায়াত নামক এই দুই পরম বন্ধুর।
বিএনপি-জামায়াত দোসরের আস্তিক-নাস্তিক এই ঘৃণ্য চক্রান্তমূলক ষড়যন্ত্র যদি না হতো, তবে এত নিরীহ মানুষ হয়তো প্রাণ হারাত না।
এই যে "গণহত্যা" নামক ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের হরতালের ঘোষণা, সেটা কী কথিত "গণহত্যা" বন্ধ করার জন্য, নাকি আরও কিছু নিরীহ মানুষ মরে গিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম করার জন্য? কথিত "গণহত্যার" প্রতিবাদে হরতাল হবে কেন? তারা সরকারের কাছে আইনানুগ বিচারের জন্য দাবি তুলতে পারে, কিন্তু দেশের সম্পদ পুড়িয়ে, নিরীহ কিছু বোকা কর্মীদের রাস্তায় নামিয়ে উত্তেজিত পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া কী “গণহত্যার” বিচার নিশ্চিত করতে পারবে? রাজনীতির আওভাও বোঝে না এমন একজন ব্যক্তিও বোঝেন যে, এভাবে কোনও হত্যার বিচার কখনোই হয় নি, হবেও না। তাহলে কেন এই হরতাল? কার জন্য?
তাদের ভাষায়, শাহবাগ আজ একটি বিশেষ দলের দলীয়করণে প্রশ্নবিদ্ধ!!কিন্তু আমরাতো সবাই চেয়েছিলাম বিএনপিও আসুক এই কাতারে। সব দল এসে সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলুক- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। আর এতে বিএনপির জনসমর্থন বাড়তো বৈ কমতো না। অথচ তারা তা না করে সম্পূর্ণ উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার দৈন্য ছাড়া এ আর কী বা হতে পারে!!
বিএনপি রাজনীতির খেলায় শুধু অদক্ষই নয় বরং তাদের মাঝে স্বাধীনতার স্বপক্ষ নামক আবছা ক্ষীণ যে চেতনাটি ছিল সেটাও যেন উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় আজ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আজ জামায়াত ও বিএনপি একাকার। তাদের চিন্তা-ভাবনা, দলীয় আদর্শ হুবহু এক হয়ে গেছে, কোথাও কোনও অমিল নেই।
ভুলে গেলে চলবে না যে, গতবারের নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম এক বিশাল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। এবারেও তার ব্যতিক্রম হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। আর শাহবাগের ওই গণজগরণ সকল প্রজন্মকেই আজ তরুনে রূপান্তরিত করেছে। এই জাগ্রত তরুণদের ধোঁকা দেওয়া এত সহজ নয়। শাহবাগ এখন “সরকারের মদতপুষ্ট”, “নাস্তিকদের আস্তানা” এইসব হাবিজাবি বলে ব্রেইনওয়াশ করা দলীয় কর্মীদের রক্ত উত্তপ্ত করা গেলেও ধীর-স্থির সুস্থ মানবিক গুণাবলীর অহিংস তরুণদের বিপথে আনা যে কখনোই সম্ভব হবে না, তা সব দলকেই মনে রাখা উচিত।
আবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে মুসলিমদের ভোট নেওয়ার জন্য যতই ইসলামের সাচ্চা সেবক হিসেবে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা করুক না কেন, মন্দিরের ভেতরে দেবীকে গুঁড়িয়ে দিয়ে অবমাননা আর সংখ্যালঘুদের বসতভিটায় আগুন জ্বালিয়ে তাদের উপর অত্যাচারে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিমরা কখনোই সমর্থন জানাবে না। কয়েকজন উগ্রপন্থি মুসলিমের ডামি দেখে যদি বিএনপি মনে করে, এটাই দেশের প্রকৃতপ্রতিচ্ছবি, তবে তারা ভুলের স্বর্গে বাস করছে। আর এই ভুলের খেসারত তারা পাবেই পাবে আসছে ইলেকশনে।
এবার ইলেকশনে যদি ভরাডুবি হয়, তবে বিএনপি নামক এই দলটির অপমৃত্যু কেউই ঠেকাতে পারবে না।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৩
জেডএম/