অস্ট্রেলিয়া থেকে: এর চেয়ে অস্বস্তিকর অসহনীয় অবস্থা আর কি হতে পারে? একদিকে মানুষের আকুতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুরাগ, বিচার প্রার্থনা ও শাস্তি নিশ্চিত করার অঙ্গীকার আর অন্যদিকে ধর্মের নামে হত্যা মারামারি লুটপাট- এখন যা চলছে তাতে কোনো সাধারণ বিবেকবান মানুষ নিশ্চিত থাকতে পারেন না।
আমরা থাকি দেশ থেকে অনেক দূরে।
আবার আমাদের বিরোধী শিবিরও কম কিছু নয়। এতোদিন চুপ করে ঘাপটি মেরে থাকলেও এখন তারাও বাইরে আসছে। বিশেষত খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনের নামে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের তার ও তার দলের সমর্থনের বিষয়টি পরিস্কার করার পর থেকেই বিএনপি র
আশ্রয়ে তারা প্রতিবাদে নেমেছে। পার্থক্য এই সভ্য দেশে আইনের সমাজে কেউ কারো মুখোমুখি হতে পারবে না। কারো টিকিটি স্পর্শ করারও সুযোগ নেই কারো।
নিরাপদ ভূমির অভিবাসী বাঙালি হিসেবে আজ আমার হৃদয় দীর্ণ। আমার বিবেক আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ কোন দেশের চেহারা দেখছি আমরা? এ কোন সমাজ?
মানুয এতো বর্বর, নিষ্ঠুর ও উন্মাদ হতে পারে? রেললাইন উপড়ে ফেলছে, ট্রেনে আগুন দি্চ্ছে। পুলিশকে মেরে তার জান কেড়ে নিচ্ছে। পতাকা পোড়াচ্ছে, মন্দির ভাঙছে।
মসজিদের কার্পেটে আগুন দিচ্ছে, লাঠি-সোটা নিয়ে ছুটে আসা এদের দেখে মনে হচ্ছে, একদল রক্তপিপাসু হায়েনা।
যে চেতনার কথা যে আদর্শের কথা বলে আমরা কাঁদি, শপথ করে আবেগে বুক ভাসাই এই তার পরিণতি? এই কি এতোদিনের রাজনীতি আর আর সংস্কৃতির ফলাফল?
এরা তো আমাদেরই কেউ না কেউ। অপরিচিত পাঞ্জাবি বা বিহারি তো নয়। আজ যারা যেসব তরুণেরা ধর্মের নামে, জামায়াতের নামে সংখ্যালঘুদের জান মাল কেড়ে নিচ্ছে, মন্দির ভাঙছে, রাজীবকে নাস্তিক মনে করে কোঁপানো জায়েজ ভাবছে, এরা কি অচেনা কেউ?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে গড়ে ওঠা এ আন্দোলনের অল্প কয়েকদিন আগের রামুর কথা ভাবুন তো! রামুর সহিংসতা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের
প্রতি আক্রমণ, বুদ্ধের ওপর নির্যাতন, বৌদ্ধদের জীবন ও মালামাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কি খুব আগের কথা? সে সংকেত আমার কেন বুঝতে পারলাম না, কেন বুঝতে পারলাম না?
এসব যুবকরাই যে কোনোদিন আমাদের জাতীয় পতাকা টুকরো করে ফেলতে পারে, আমাদের জাতীয় সংগীতকে অপমান করতে পারে, আমাদের যুব সম্প্রদায়কে নাস্তিক বানিয়ে কোঁপাতে পারে, মেয়েদের গালি দিতে পারে, কেন রাজনীতি তা বুঝল না?
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে, তার মাথার ওপর বঙ্গবন্ধু নেই, আকাশ নেই, নেই তাজ উদ্দীনের মতো ছাদ! তার বর্তমান নেতৃত্ব জনগণের আস্থা বা বিশ্বাসের এমন কোনো জায়গায় নেই যে, ডাক দিলেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে। যে কারণে শাহবাগের গোড়ার দিকে তারা ভিড়তেও পারেননি। একজনকেও জায়গা দেয়নি ছাত্র যুবসমাজ।
কিন্তু রাজনীতির ছলের অভাব নেই। ছলে বলে কৌশলে দ্বিধাবিভক্ত দেশীয় রাজনীতির এক প্রান্তে এসে ঠেকা শাহবাগের ওপর আক্রোশ শানাতে গিয়ে আজ আমাদের চেতনা আর আস্থার জায়গাটুকু নিয়ে শেষ খেলায় মেতেছে পরাজিত দুশমন, রাজাকার ও দালাল বাহিনী। তারা এখন জ্বালাও-পোড়াও আর মরো ও মারার নীতিতে অটল!
এমনটি যে হবে ধারণা করার নামই তো রাজনীতি নাকি? তাহলে আজ প্রশ্ন জাগে, কথিত আওয়ামী লীগের বাঘ সিংহরা কোথায়? তারা কি ভয় পেয়েছেন? না কম্প্রোমাইজড? তাদের ছেলেরা বা তারা তো জান দিচ্ছেন না! জান যাচ্ছে নীরিহ মানুষের। এ হায়েনারা আর কয়েকদিন পর একাত্তরের মতোই বাসায় বাসায় গিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের মেরে আসবে, দ্রৌপদীর মত লাঞ্ছিত হবেন মা-বোনেরা!
ধর্ম ও রাজনীতি সমার্থক হলে কি হয়, কি হতে পারে সেটাও তো আমাদের অজানা কিছু নয়।
সংবাদপত্র-টক শো’তে জানতে পারলাম, সাঈদীর ফাঁসির রায়ের দিনই আদালতে হই চই করে তাকে বলা হয়েছিল, ‘‘চিন্তা নাই। এমন পরিস্থিতি হবে, যাতে দেশের বা সরকারের বারোটা বাজনো হবে! তখন সরকারও শেষ, বিচারও খতম!
এরপরও আওয়ামী লীগের হুঁশ নাই! তাদের হুঁশ থাক না থাক, আমাদের অস্তিত্ব আর বাঁচা-মরার প্রশ্ন। আমরা আরেকটি একাত্তর চাই বটে, একাত্তরের
মতো মৃত্যু বা ধ্বংস চাই না। রক্তপাত আর দেশদ্রোহীরা আমাদের তারুণ্যকে আর কতোকাল এভাবে অস্থির করে রাখবে? বারংবার ৪৭ এর বাস্তবতায় ফিরে যাবার ভেতর গৌরব নেই। পাওয়ার গেম বা যে কোনো ছলনার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর নিরাপত্তাই আজ জরুরি।
সরকার কেন তা পারছে না? কোথায় রাজনৈতিক শক্তি? ভোটের দিন ভোটের বাক্স পাহারার দিন যে আওয়ামী লীগ বা দেশজ রাজনৈতিক শক্তির চেহারা দেখি, দুর্দিনে সে কোথায়? এখনো যদি সে ঘুরে না দাঁড়ায়, আর কখন তার বোধোদয় হবে? দেশ ও দেশের সর্বস্ব হারালে?
আমাদের সন্তানদের তো আমরা হিংস্র হায়েনার মুখে ছেড়ে দিতে পারি না। তারা অনেক করেছে, এবার তারুণ্যের প্রতিনিধিরা, আপনারা দায়িত্ব নিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০১৩
সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর