ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফরহাদ মজহারের প্রতি খোলাচিঠি

সাঈদ ফেরদৌস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০১৩
ফরহাদ মজহারের প্রতি খোলাচিঠি

`হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন` (তবে ভাসুরের নাম মুখে নিতে নাই)

তাহলে বাংলাদেশে এখন চলছে সরকারের বিরুদ্ধে নামহীন গোত্রহীন মানুষের বিক্ষোভ? আর এই বিক্ষোভ সামাল দিতে বেসামাল সরকারের পেটোয়া পুলিশ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে? কিন্তু জনাব ফরহাদ মজহার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য মরিয়া জামায়াত; সে কথাটা আপনি বলেননি। তারা নাশকতা সৃষ্টি করছে আর তাতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মাদ্রাসামুখীন বিপুল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে যুক্ত করবার জন্য তারা সাঈদী-চাঁদ-এর মতো নানান মিথ্যাচার, ভাঁওতাবাজির আশ্রয় নিচ্ছে।

সেটাও আপনি বলেননি। সংখ্যালঘুদের ঘরে ঘরে কারা আগুন দিচ্ছে তাও আপনার বলবার তালিকায় নাই। আপনি কেবল দেখিয়েছেন জনতার বিক্ষোভ, যারা শাসকের সন্ত্রাসী পুলিশের ওপর আক্রমণ করছে। মিনমিন করে আপনি তার নিন্দা করেছেন বটে; তবে আখেরে আপনার ফয়সালা হলো, যেহেতু তারা জালেম সরকারের হাতে নির্যাতিত, সেহেতু এই মজলুম জনতা তাদের বিপ্লব কায়েম করতে পিটিয়ে যে পুলিশ মারছে তার দায় ওই জুলুমবাজ সরকার আর তার পুলিশের কাঁধেই বর্তায়। যদি সত্যিই নামহীন নিপীড়িত মানুষেরা কারো প্ররোচনা ছাড়াই স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভে সামিল হতো আমরা হয়ত তাকে সাব-অল্টার্ন চৈতন্যের স্মারক ভাবতে পারতাম। কিন্তু পরিষ্কার রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে উস্কানি ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্র আর তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যখন মানুষকে খেপিয়ে তুললো জামায়াত, আপনি তখন তাকে নিছক জনতার বিক্ষোভ হিসেবে দেখেন কেন? একটা দল দেশজুড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দিতে চাইছে, থানা পুড়িয়ে দিতে চাইছে, তার অর্থ কি? বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র একথা প্রমাণ হলে জামায়াতের কি লাভ আমি বুঝি; কিন্তু আপনার তাতে কি স্বার্থ? পুলিশ নির্বিচারে মানুষ মেরে ফেলবে এটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়; রাষ্ট্র খোদ সন্ত্রাসী হয়ে উঠুক সেটাও আমি চাই না। কিন্তু তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আপনাকে জামায়াতের নাশকতা আড়াল করতে হবে কেন?

শাহবাগের বিরুদ্ধে আপনার শক্ত অভিযোগ হলো শাহবাগ বিচার চায় না; বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চায়। আপনি সত্যিই তাই মনে করেন জনাব মজহার? পাবলিক লিঞ্চিং কথাটা আপনি লিখতে পারলেন! মজহার, আপনার মনে হলো না যে আপনি যা করছেন সেটার সোজাসাপ্টা নাম প্রোপাগান্ডা? আইনি বিচারে আপনি এই কথা বলে পার পেয়ে যাবেন হয়ত; যেহেতু শাহবাগের সবচাইতে উচ্চারিত শ্লোগান হলো, ‘ফাঁসি চাই’। কিন্তু এই তরুণদের দেখে কি আপনার মনে হয় যে এরা এতোটাই রক্তপিপাসু? এদের দেখে কি মনে হয় যে এরা কাউকে খুন করবার জন্য দিনের পর রাত রাতের পর  দিন ধৈর্য্য নিয়ে বসে আছে? বসে আছে কারো রক্তপানের জন্যে?

জাতীয়তাবাদের একটা উন্মাদনা আছে সত্য, এবং অনেক বাদানুবাদের পরেও সেটা শাহবাগে আছে সেটাও সত্য। কিন্তু ওই জনতা যদি রক্তপিপাসু-ই হতো, তাহলে পাশেই চিকিৎসাধীন গোলাম আযমকে টেনে নামাতে তার কয় সেকেন্ড লাগতো? যেখানে অনেকেই এই ফাঁসির দাবিটিকে আক্ষরিক অর্থে না ধরে তার পেছনের বিচার প্রার্থনাকে শাহবাগের মূল টোন হিসেবে দেখতে পান, সেখানে আপনি কেন পাবলিক লিঞ্চিং এর মেটাফোর সামনে আনেন? শাহবাগকে ভিলেনাইজ করার মধ্য দিয়ে আপনি চলমান প্রক্রিয়াতে কার পক্ষ নেন? জনাব মজহার আপনি তো জানেন যে শাহবাগের আরো ম্যালা দোষ; শাহবাগ ‘নাস্তিক’, ‘নেশাখোর’ আর ‘পতিতা’-র আখড়া। আপনি জানেন যে শাহবাগের বিরুদ্ধে জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধ বিচার বিরোধীরা সংগঠিত মিথ্যাচার চালাচ্ছে দিনের পর দিন। এই সকল মিথ্যাচার নিয়ে আপনার কোনো আপত্তি নাই কেন? শাহবাগের তরুণদের দাবির মর্মটা না ধরে আপনি তাদের দোষটা সামনে আনলেন; কিন্তু তাদের নামে যারা নাহক কথা রটাচ্ছে তা নিয়ে আপনি টুঁ শব্দটিও করলেন না।

জনাব মজহার, এই যুগে বসে আমরা সবাই জানি সত্যকে আমরা সবাই যার যার মতো করেই দেখতে পাই, দেখাই। পুরো সত্য বলা/দেখা/দেখানো কখনোই সম্ভব নয় সেটাও আমরা জানি। প্রশ্ন হলো, আপনি কি দেখতে চান এবং কেন।

আপনি যদি বলেন স্বাধীনতা উত্তর এদেশের তাবৎ সরকারগুলো ছিলো বিপুল জনগোষ্ঠী হতে বিযুক্ত; তাদের অনেকেই প্রচুর ভোট পেয়েছে, কিন্তু জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার  প্রতিফলন তাদের কাজে ছিলো না, আমি তা মাথা পেতে নেবো। যদি বলেন তারা ছিলো, দূর্নীতিপরায়ণ, এলিট, যারা সাম্রাজ্যবাদের দালালি করেছে, সেটাও আমি কমবেশি মেনে নেবো। যদিও মুজিব-এর মৃত্যু সেক্ষেত্র ভিন্ন কথা বলে। যদি বলেন সেক্যুলারিজম কোন মুক্তিদায়ী মতবাদ নয় আমি সেই বিষয়ে আপনার সাথে এনগেজ করতে চাইবো। কিন্তু এগুলোকে প্রেক্ষাপট হিসেবে হাজির করে আর বামপন্থী শ্রেণীর লড়াই-এর কমরেডদের খারিজ করে আপনি যদি বলেন শ্রেণীর লড়াই আনবে ধর্মভিত্তিক জেহাদি রাজনীতি তাহলে আমার নড়ে চড়ে বসতে হয়।

বছর কয়েক আগে যখন ইসলামী জঙ্গিরা দেশজুড়ে বোমাবাজি করছিলো আপনি তাতে শুনেছিলেন শ্রেণী লড়াইয়ের আওয়াজ; বঞ্চিত মানুষ সন্ত্রাসের ভাষায় দেশীয় আর সাম্রাজ্যবাদী এলিটদের নিপীড়নের জবাব দিচ্ছে, এই ছিল আপনার তত্ত্ব। মনে আছে, তখন আক্রমণের টার্গেট ছিলো আদালত, মাজার; প্রশ্ন হলো, কারা যায় সেখানে? সেখানে বোমায় কে মরবে? তারা কোন শ্রেণীর মানুষ? এবারে যে সংখ্যালঘুর ঘর পুড়লো তারা, কিংবা যে পুলিশ কনস্টেবল মারা গেলেন তারা কোন শ্রেণীর? প্রান্তিক মানুষগুলো মারা পড়ছে তাদেরই মতো প্রান্তিক আরেক দলের হাতে। এটা কেমন শ্রেণীর লড়াই? এটা কেমনতর বিপ্লবী শক্তির প্রকাশ?

কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক জামায়াতে ইসলামী আর তার বিত্তবান নেতারা সমাজের কোন মৌলিক বদল আনবেন? সাঈদীর জন্যে যে মাদ্রাসার ছাত্র মিছিল করেন, তার মুক্তির জন্যে সৃষ্ট উন্মাদনায় যে নিরীহ মানুষদের প্রাণ যায়, তাতে কার শ্রেণীস্বার্থ রক্ষিত হয়?

বাংলাদেশের সকল বড় রাজনৈতিক দলগুলো যে অর্থে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক, জামায়াত কি কোনো অর্থে তার ব্যতিক্রম? এই প্রশ্নগুলো কি আপনার বিবেচনায় আছে জনাব মজহার? এইগুলো বিবেচনায় রাখলে পরে কি করে আপনি চলমান সহিংসতায় জামায়াতের দায়-দায়িত্ব বেমালুম চেপে যান?

জনাব ফরহাদ মজহার, আপনি দেশ স্বাধীন হবার কথা তুলে লেখা শেষ করেছেন; আপনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের গুরুত্বের কথাও মেনে নিয়েছেন। আপনার তো জানা আছে মজহার, জামায়াত ১৯৭১ সালে সাংগঠনিকভাবে এদেশের মানুষকে হত্যা, গুম, খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের সাথে জড়িত ছিলো। তারা আজ অব্দি কখনোই সেই ভূমিকার জন্যে এইদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি; বরং একাত্তর প্রসঙ্গে ধারাবাহিক মিথ্যাচার করে গেছে নানান সময়ে। আপনার লেখায় সে বিষয়ে একটি বাক্যও নাই কেন?

[লেখাটি একটি পত্রিকার অনলাইন-এ কবি, প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন’ শিরোনামে ২ মার্চ প্রকাশিত রচনার প্রতিক্রিয়ায় রচিত। ‍]
sayeed-ferdous
সাঈদ ফেরদৌস, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।



বাংলাদেশ সময় : ১৭০২ ঘণ্টা, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
সম্পাদনা : এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।