বাংলাভাষা বোধ করি এমন এক ভাষা যেখানে প্রতিনিয়তই ঢুকছে নতুন নতুন শব্দ। যদিও বাংলা একাডেমী নতুন নতুন উদ্ভাবিত সব শব্দ গ্রহণ করে স্বীকৃতি দিয়েছে এমন নজির কম।
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পর ‘ছাগু’ আর ‘ত্যানা-পেচানো ছাগু’ বলে গালি আর বিদ্রুপ যারা শোনেননি তার নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করতেই পারেন। এই না শোনা মানুষ গুলোর একটা বড় অংশ ফেসবুক বা ব্লগে কোনরূপ মন্তব্য দেওয়া থেকে হয় বিরত রেখেছেন। নয়তো তারা শাহবাগের আন্দোলনকে কোনরূপ প্রশ্ন বা শর্ত ব্যাতিরেকে মেনে নিয়েছেন, সমর্থন দিয়েছেন, সেভাবেই ভেবেছেন যেভাবে ভাবছে শাহবাগ নেতৃত্ব।
বোধকরি এই শব্দযুগলের সৃষ্টি প্রথমে বাংলাব্লগাবর্তে। জামায়াত-শিবিরের অনলাইন আর ব্লগকর্মীদের কে হেয় করা জন্য যোগ্যতম গালি হিসেবে দ্রুত প্রচার আর প্রসার পেয়েছে শব্দগুলি। তবে কালের প্ররিক্রমায় এই শব্দযুগল ব্যবহৃত হচ্ছে আরো বড় পরিসরে, ব্যাপকাকারে। এই শব্দের সীমারেখায় পড়ছেন যারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে একক আন্দোলনে না রেখে পদ্মাসেতুর দূর্নীতি, সাগর-রুনি হত্যার বিচার প্রভৃতিকে সামনে আনতে চাচ্ছেন তারাও। সরকার বিরোধী বিএনপির ব্যাপক কর্মী-সমর্থকরা নির্বিচারে পড়ছেন এই তালিকায় কারণ,তারাও তাদের দলের মত বিচার চান কিন্তু তাদের ভাষায় ‘তা হতে হবে স্বচ্ছ ও আর্ন্তজাতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে’। তাদের ভাষায় ‘আমরাও শাহবাগ তারুণ্যের আন্দোলনে আছি তবে তরুণদের কে সোচ্চার হতে হবে সরকারের অনিয়ম, ব্যর্থতা আর লুটপাটের বিরুদ্ধে’। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার আর ফাসির দাবির আন্দোলন তো আর এমন বিষয় নয়, যার সাথে জুড়ে দিতে হবে অগুরুত্বপূর্ণ সব রাজনৈতিক দাবি! সেই সব মানুষগুলো ছাড়াও শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে চুল পরিমান প্রশ্ন উঠানো মানুষদের কপালে জুটছে এই শব্দযুগল। ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, এমন কি সরকার দলীয় এমপিকে কেউ কেউ নিমিষেই বানিয়ে ফেলছেন ‘ছাগু’।
যারা ‘ত্যানা পেছানো’ আর ‘ছাগু’ শব্দের গালি খাবার ভয়ে থাকেন তাদের জন্য বলি, এটি রাজাকার বা শিবির নামক গালির চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম অপমানের। জামায়াত-শিবির দলীয় কর্মী বা সমর্থক হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে বলে যারা বা এই বিচার মানেন না এমন গোষ্ঠীই সরাসরি রাজাকার বা শিবির নামে পরিচিত। আর ‘ছাগু’ ও ‘ত্যানা প্যাচানো ছাগু’ অভিহিত হন তারাই যারা আইন, যুক্তি নীতি নৈতিকতার মানদণ্ডে বিচার চান। অথবা এই শব্দযুগলের প্রয়োগ হচ্ছে তাদের বেলাতেও যারা শাহবাগের গণজাগরণে গিয়েছেন কিন্তু এর দলীয় রূপ বা রাজনীতির দিকটি সম্পর্কে বলছেন তারাও। বলাই বাহুল্য আমি আমার কিছু সহর্কমীর কাছে প্রকাশ্য বা মনে মনে এই দু-শব্দ প্রয়োগের মোক্ষম মানুষ হয়ে গেছি। কারণ, রাজাকারের ফাসির বাইরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, বিচারপ্রক্রিয়া আর শাহবাগ আন্দোলনের পেছনের রাজনীতি নিয়ে ‘ইতি-উতি-গ্যাতি-গুতি’ কিছুটা হলেও এসেছে আমার মধ্যে।
এ এক আজব বিপদ! সাংবাদিকতা করতে গিয়ে এই স্বল্প অভিজ্ঞতাতেও সব সময় জেনেছি সংবাদের পেছনে থাকে সংবাদ। দৃশ্যের পেছনেও থাকে দৃশ্যপট। সেই দৃশ্যপট আর পেছনের সংবাদ তুলে আনা-ই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। জার্নালিজমের ভাষায় ‘বাইফোকাল মাইন্ড’ (বাইফোকাল চশমায় দূরের ও কাছেরটা দেখতে পাওয়ার মতো) ব্যবহার করে দেখতে হবে সামনের ঘটনার ভবিষ্যত কেও। শাহবাগের ঘটনাপ্রবাহকে দিনের সংবাদ হিসেবে দেখলে এর চেয়ে বড় কোন আবেগী সংবাদ হয় না। আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধ আর সেই যুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের ফাসির দাবির ব্যাপারে কোন রকম দূর্বলতা বা রাজনীতি খোঁজার চেয়ে আত্বঘাতি অনুসন্ধান মনে হয় আর নেই। বাই ফোকাল মাইন্ড ব্যবহার করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হচ্ছে তো। এই আন্দোলনের প্রাপ্তি হিসেবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা তরুণ প্রজন্মে ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং এর সম্ভাব্য ভবিষ্যত ভেবে আমাদের গণমাধ্যমগুলো সেসব চেতনা ছড়িয়ে দেবার কাজেই বেশি মনোযোগী। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আমাদের সেখানেই।
কিন্তু মুদ্রার এপীঠ থাকলে ওপীঠ তো থাকবেই। তাই, এ আন্দোলন চাঙ্গা রাখতে ওয়ার্ড ওয়ার্ড থেকে দলীয় কর্মী আনা, এর নেতৃত্ব, সরকারি পৃষ্টপোষকতার বাহুল্যে তরুণ প্রজন্মের আবেগ রাজনৈতিক ফায়দা লাভে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, অথবা ন্যায়বিচার, স্বচ্ছবিচার, স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ধারণার বাইরে দাবি আদায়ে রাজপথের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে – ও হীন কৌশলে এই যে শতাধিক প্রানহানী ঘটলো, কেন ঘটলো, যারা মরছে সবাই শিবির কর্মী কিনা এসব নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কাজ করে না। অথবা যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমরা সব সময় সরব, সেই বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড এখন অনায়াসে ঘটছে কোন পটভুমিতে! জাতীয় ঐক্য বা জবাবদিহিতার সুশাসন থাকলে এগুলো এড়ানো যেত কিনা এসব বিষয়ে আমরা একেবারেই নিশ্চুপ শুধু নই, বরং সাফাই গাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট শ্রদ্ধাভাজন সব ব্যক্তি আর গোষ্টীর মুখে। আমাদের শ্রদ্ধাভাজনরা চুপ বা মেনে নিচ্ছেন তার একটি বড় কারণ হতে পারে এটাতে ভিন্নমতের কোন সুযোগ নেই। অন্য কারণটি হতে পারে তারাও ত্যানা পেচানো ছাগু উপাধি পেতে চাচ্ছেন না। রাজাকার গালি তো আরো বড় অসম্মান।
তবে যারা ভয় পাচ্ছেন তাদের জন্য সুখবর হলো- এই ‘ত্যানা প্যাচানো ছাগু’ নামে গালি শোনার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ভয়াবহ গতিতে। হালে যুক্ত হয়েছেন তরুণ রাজনৈতিক নেতা মাহি বি চৌধুরী। টিভি টক শোতে তার মন্তব্যের জন্যে। সরকার দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি এই গাল খেয়েই যাচ্ছেন তার দলীয় ভাবনার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার গোলমাল নিয়ে কথা বলা ও লেখালেখির কারণে। আন্দালিভ রহমান পার্থ আর শিল্পী আসিফ আকবরকে আগেই দেওয়া হয়েছে এই উপমা। আর বাংলাদেশ প্রতিদিনের পীর হাবিবও যুক্ত হয়েছেন নতুন তালিকায়। শুধু মানুষ নয় যে সকল প্রতিষ্ঠান একটু ভিন্ন মোড়কে সংবাদ পরিবেশন করছে তাদের কপালেও জুটেছে গালি। এমনি কি আল-জাজিরা টিভি্ও ফেসবুক মহলে পরিচিত পাচ্ছে ছাগু-টিভি নামে। সম্প্রতি মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ কে, কেউ কেউ ছাগু সংস্থা বলে অভিহিত করছেন যেটির উদ্যোক্তা আদিলুর রহমান খান কিনা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আর সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব থেকেছেন সব সময়।
ড. আসিফ নজরুল, নূরুল কবির, মতিউর রহমান চৌধুরী, ফরহাদ মজহার অনেক দিন থেকেই আছেন সে তালিকায়। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি, ড. পিয়াস করিম, মাহমুদুর রহমানরা অবশ্য অনন্য উচ্চতায়। তাদের নামে রাজাকার উপাধি বসিয়ে স্লোগান ধরাও হয়েছে।
তার ও আগে প্রকাশ্যে না হলেও ড. মুহম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার, ড.আকবর আলী খান, ব্রাকের ফজলে হাসান আবেদ প্রমূখ ব্যক্তিরা আন্দোলনকারীদের মনে মনে ছাগু হিসেবে পরিচিত হয়ে বসে আছেন। কারণ, তারা কেউ আজও পর্যন্ত যাননি শাহবাগের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণায়।
এতগুলো মানুষ যদি ‘ছাগু’ আর ‘ত্যানাপেচানো ছাগু’র উপাধি পায় তাহলে কথা বাড়িয়ে খামোখা দরকার কি! তার চেয়ে আমার একদফা এক দাবিতেই থাকা কি ভালো নয়? সে জন্যেই তো টিভি সাংবাদিকতায় আমাদের পথিকৃত এক ভাই একটা সুন্দর স্টেটাস দিয়েছেন ফেসবুকে-‘এত কথার দরকার নাই- রাজাকারের ফাসি চাই’।
সাহেদ আলম, সংবাদকর্মী, shahedalam1@gamil.com
বাংলাদেশ সময় ১২৩১ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৩
এমএমকে