শাসনতন্ত্রের সংবিধানে যাই থাকুক, আমার এ দেশ সবসময়ই ছিল অসাম্প্রদায়িক। আমার দেশের মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী, পরধর্মে সহনশীল।
বিশিষ্ট সাংবাদিক নঈম নিজাম তার লেখায় বর্ণনা করেছেন তার গ্রামের ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা। শ্রদ্বাভাজন সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানও তার জেলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্মৃতিচারণ করেছেন গণমাধ্যমে। আমার মনে হয় কিছু হীনমন্য ও ব্যক্তি স্বার্থের ধারক ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হ¦দয়পটে এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরই ছবি। আমরা দেখেছি মসজিদ এবং মন্দির দুই জায়গাতেই মোমবাতি জা¡লাতে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আনন্দে মেতে উঠতে দেখেছি পয়লা বৈশাখের মেলায়, ঈদের দিনে প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছেলেমেয়েদেরও দেখেছি নতুন পোশাকে। ধর্ম যারই হোক উৎসব পরিণত হয়েছে সবার জন্য। হিন্দু মুসলমানের নয় এগুলি বাঙালি সংস্কৃতি, সম্প্রীতিরই ধারক।
চন্দ্র শীলরা চাঁন মিয়া হয়েছেন তার বাঙালি পরিচয়ের অনেক পরে। এদেশে বাঙালি সংস্কৃতির প্রচলন চার হাজার বছরেরও পুরনো যেখানে মানবের কল্যাণে ইসলাম এসেছে দেড় হাজার বছর আগে। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, বাংলার আদিম মানবগোষ্ঠী আর্য বংশোদ্ভূত নয়; বরং বর্তমানকালের কোল, ভীল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ি ও চণ্ডাল প্রভুতি জনগোষ্ঠীই হলো বাংলার আদিম মানব সমাজের উত্তরপুরুষ।
প্রাচীন সংস্কৃতি আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই বাংলা এখন এক ভয়াবহ খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধপরাধীদের বিচার এবং তরুণ প্রজন্মের জাগরণকে ঘিরে আমাদের রাজনীতি এক ভয়াবহ সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। ক্ষমতার মসনদ পেতে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুর্লির কৌশল কিংবা অপকৌশল স্পষ্টত বিভাজনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে দেশকে। দেশের প্রধান দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে রাজনীতি করে। শাহবাগের আন্দোলন শধু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতেই নয় এই আন্দোলনের বার্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। তাই এই জাগরণ জাতিকে একটা চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক নতুন মেরুকরণের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল। কিন্তু আমরা সেটা উপলব্ধি না করে বরং দেশকে বিভাজনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা এখানেই। তারা দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে কায়েমী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে বিভাজনকে উস্কে দিচ্ছেন।
দেশের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে অনেক সাংবাদিক, বুদ্ধিজিবীরাও স্বার্থপরের মতো আচরণ করছেন। দেশের স্বার্থ না দেখে সুবিধাভোগী শ্রেণি-গোষ্ঠীর স্বার্থকেই বড় করে দেখছেন। সমাজে অস্থিরতা, সংঘাত ও অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সরকারি দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বে কাউকে ভাগ বসাতে দিতে চায় না। এরকম সংঘাতময় পরিস্থিতিতেও সরকার বিরোধী দলসহ স্বাধীনতার পক্ষের সকল দলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন রাজনৈতিক উদ্যোগ বা আহ্বান জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল, জ্যেষ্ঠ নাগরিকবৃন্দ, সুশীল সমাজসহ তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নব চেতনায় উজ্জীবিত জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রয়াস নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রসমুহের সাথে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতার মাধমে আন্তর্জাতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তেমন সফলতা দেখা যায়নি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বা চিরস্থায়ী শত্রুতা বলে কিছু নেই। বিগত সময়ের কিছু ঘটনায় পরাশক্তি কোন রাষ্ট্রের সাথে আমাদের কুটনৈতিক টানাপোড়েন এর কথা গণমাধ্যমে আমরা শুনেছি। যেকোন দেশেরই কূটনৈতিক সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও থাকবে কিন্তু ব্যর্থতা অস্বীকার করে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মাধম্যে তিক্ততা সৃষ্টি আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের কূটনীতি হতে পারে না। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না বরং ব্যর্থতার দায় নিয়ে নতুন কৌশল ও দক্ষতায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলকে নিজের অনুকুলে রাখার মতো কূটনৈতিক পরিপক্কতা আমাদের ছিল না। বড় কোন বিজয়ের জন্য ছোট ছোট পরাজয়কে কৌশল হিসাবে নেয়াটাই শ্রেয়।
প্রধান বিরোধী দলের বর্তমান অবস্থান তাদের তরুণ প্রজন্মের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। একসময়ে যে তরুণ প্রজন্ম ছিল বিএনপির মূল শক্তি সেই তরুণ প্রজন্মের আবেগের বিপরীতে এখন তারা। ধর্ম রক্ষা, ভারত বিদ্বেষ, একদলীয় শাসন--এই কার্ডগুলিতো অচল হয়ে পড়েছে ৯৬-এর পরে। ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত সময়ে এই কার্ডগুলিকে টেক্কা দিয়েইতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছে।
এদেশের মানুষ ধর্মের অবমাননা যেমন মেনে নেয় না তেমনি মেনে নিতে পারে না মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাতকেও। বিএনপি নেতৃবৃন্দরা নতুন প্রজন্মের আবেগ আমলে নিয়ে তাদের জাগরণকে মূল্য দিয়ে একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত এই তরুণদের পাশে রাখতে পারতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সফলতা কোন একক দলের ফসল নয়, এটা এদেশের প্রতিটা বাঙালির গৌরব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আহ্বানে এদেশের জনতা কিভাবে সাড়া দেয় সেটা দেশবাসী দেখেছে শাহবাগ চত্বরে। সাড়া দেশ দেখলেও বিএনপি নেতৃবৃন্দ তা অনুধাবন করতে পারেননি তাদের উপর স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির প্রভাবে। বিএনপির মত দলের একাত্তরের চেতনায় দ্বিধা থাকবে কেন? একাত্তরের চেতনা শুধু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিই নয়। একাত্তরের চেতনা একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের, একাত্তরের চেতনা শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশের।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে মহানায়কদের গৌরবগাঁথা ইতিহাস পড়ে আজকের তরুণরা উজ্জীবিত, যাদের মুখের স্লোগান ”জয়বাংলা” ”তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা” ধ্বনিতে উত্তাল এই দেশ সেই মহানায়কদের অধিকাংশই এখনো এদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। তবে কেন তারা আজ নীরব? রাজনীতির সেই অতি পরিচিত কথা ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। নতুন প্রজন্মের সাথে এসব মহানায়কদের ঐক্য নিশ্চিতভাবে টেনে দিতে পারে একটা রাজনৈতিক সীমারেখা, যার মধ্যে প্রবেশাধিকার পাবে না একজন রাজাকারও। অনেকটা দেরিতে হলেও স্বাধীনতার ৪২ বছর পর এটা নিশ্চিত করার সময় এসেছে যে, প্রতিটা নাগরিক এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, এদেশের জাতীয় পতাকাকে সম্মান করে। স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভিন্ন মতাদর্শের, ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দল থাকতেই পারে তাই বলে এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এমন কোন ব্যক্তি বা দলের ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমার এই দেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে না। এদেশ আমার সোনার বাংলা আমরা একে ভালবাসি ।
লেখক: চট্রগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা
বাংলাদেশ সময়: ১৫২০ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৩