বিএনপি কর্মীরা ঠিকই করেছেন। মঙ্গলবারের হরতালে তারা জামায়াত-শিবিরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েননি।
‘মহান মানবাধিকারকর্মী’ ফরহাদ মজহারদের এখন অন্ততঃ বোঝা উচিত কোন্ অবস্থায় হতাহতের ঘটনা ঘটে, কোন্ অবস্থায় তা ঘটে না। তারপরও মঙ্গলবার মৃত্যুহীন দিন হতে পারেনি। ফরহাদ মজহারদের শ্রেণী সংগ্রামের নতুন দল জামায়াত-শিবির আগের কয়েকদিন যে সহিংসতা চালিয়েছে তাতে এদিন মৃত্যুবরণ করেছেন আহত এক পুলিশ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের এক নেতা ।
বিএনপির হরতালে জামায়াতের মতো সহিংসতা না হওয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের পক্ষে প্রপাগান্ডায় ব্যস্ত জামায়াতপন্থী কয়েকটি গণমাধ্যমে তাই বেশ হতাশা। ঘুরেফিরে তারা বলতে চেয়েছে, বিএনপির কেন্দ্রীয়, নগর এবং মাঠ পর্যায়ের নেতারা কথা রাখেন নি। খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাঠে নামেন নি তারা। এভাবে বিএনপি নেতাদের সমালোচনা করলেও প্রপাগান্ডার গণমাধ্যম হয় বুঝতে পারেনি বা বুঝতে চায়নি যে, বিএনপিকর্মীদের পালস বুঝতে পেরেই বিএনপি নেতারা তাদের হরতালে নামতে বলেননি; নিজেরাও সহিংসতা সৃষ্টির উস্কানি থেকে দূরে থেকেছেন।
খালেদা জিয়ার ডাকা হরতালে এভাবে সাড়া না দিয়ে বিএনপিকর্মীরা তাদের নেত্রীকে এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের আর কোলে রাখতে চান না। তারা বুঝতে পেরেছেন ‘তাদের যে বধিবে’ সেই সাপ তাদের ভেতরেই দুধ-কলা খেয়ে ফণা তুলছে।
তবে খালেদা জিয়া কর্মীদের মন পড়তে পেরেছেন বলে মনে হয় না। হরতালের বিকেলে যাত্রাবাড়ির সমাবেশ থেকে গণজাগরণ মঞ্চ আবারও বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ ছেড়ে জনতার পক্ষে আসার আহ্বান জানানোর ঘন্টা কয়েকের মধ্যে খালেদা জিয়া ১৮ দলীয় জোটের বৈঠক ডেকেছেন। এই ১৮ দলীয় জোটটি আসলে বিএনপি-জামায়াত জোট।
৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায়ে অসন্তুষ্ট মানুষের অভূতপূর্ব গণজাগরণের পর এটাই বিএনপি-জামায়াত প্রথম মোলাকাত। শাহবাগের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গত এক মাস বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে মাঠের কোনো কর্মসূচিতে আসেনি। একজনের সঙ্গে আরেকজনের সমর্থন-নৈতিক সমর্থনের নামে পেয়ার-দোস্তি থাকলেও অন্ততঃ প্রকাশ্যে এক টেবিলে বসে নি। নতুনভাবে সেই মোলাকাত শুরু করতে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া নিজে।
অথচ গণজাগরণ মঞ্চ বারবারই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দল হিসেবে বিএনপিকে তাদের পাশে চেয়েছে। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে হরতাল ঘোষণার পরও তারা গণতন্ত্র এবং বিরোধীদলের প্রতি সম্মান জানিয়ে হরতালবিরোধী কোনো কর্মসূচি দেয়নি। সর্বশেষ যাত্রাবাড়ির সমাবেশ থেকেও বিএনপির নৈতিক সমর্থন চেয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। ১৮ দলীয় জোটের বৈঠক ডেকে তার উত্তর হাতে হাতে দিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া।
শাহবাগে প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর হতচকিত বিএনপি সিদ্ধান্ত জানাতে এক সপ্তাহ সময় নিলেও ওই আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েছিলো। তবে জামায়াতকে ‘ডিভোর্স’ দেওয়ার কোনো কথা ছিলো না। বরং বিএনপির অনেক দলীয় এজেন্ডা গণজাগরণ মঞ্চের দাবিতে যোগ করার আহ্বান জানানো হয় তখন। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যেহেতু শুধু যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির এক দফা দাবিতে, তাই তাদের সেই সুযোগ ছিলো না।
এরমধ্যেই সাঈদীর মামলায় রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে জামায়াতের সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে সবাইকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। তার আহ্বানে কে রাজপথে নেমেছে, কে নামেনি; বাংলাদেশ তা দেখেছে। ‘চাঁদে সাঈদীর মুখ’ দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে নিরীহ মানুষকে জেহাদে নামার আহ্বান জানিয়ে দেশকে আরও রক্তাক্ত করেছে জামায়াত-শিবির। নতুনভাবে আক্রান্ত হয়েছেন সংখ্যালঘুরা।
দু’ দিন পর খালেদা জিয়া কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। এবার বিবৃতিতে তিনি যখন থামতে বললেন ততক্ষণে ক্ষতি হয়ে গেছে অনেক। তারপরও ওই বিবৃতিতে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবকে ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের লড়াই’ বলেছেন তিনি। তবে কথিত সেই প্রতিরোধের লড়াইয়ে তাঁর দলের কর্মীরা পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ায় জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী বাঁচানোর ‘জেহাদ’ ছাড়া ভরসা পাচ্ছেন না খালেদা জিয়া।
জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই, (znewaz@gmail.com)
বাংলাদেশ সময় ১৬১৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৩