গণমানুষের নেতা আবদুল জলিল। পরীক্ষিত রাজনীতিবিদ আবদুল জলিল।
কিছু কিছু মত্যু আছে তুমুল নাড়া দিয়ে যায়। ৬ মার্চ তেমনি একটি দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সাংবাদিকতায় নাম লেখানো আহমদ জামান চৌধুরী (যাকে সবাই আজাচৌ বলে জানতেন) চলে গেছেন দুপুরে। আর সন্ধ্যায় ঢাকায় খবর আসে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চলে গেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক প্রিয়, আলোচিত মুখ আবদুল জলিল।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আবদুল জলিলের অবদান কতটুকু তা নিয়ে নিশ্চয়ই এক সময় গবেষণা হবে। তবে আমরা যারা খুব কাছ থেকে এ মানুষটিকে দেখেছি তারা আঁচ করতে পেরেছি তিনি মানুষ হিসেবে অনেক বড়। সময়ের প্রয়োজনে বড় বড় দায়িত্ব তিনি একাই কাধে নিতে পারতেন। ভয় পেতেন না কোনও কিছুকে।
দৈনিক যুগান্তরের এক ক্রান্তিকালে আওয়ামী লীগের সংবাদ করার দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে। আবদুল জলিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বিএনপি-জামায়াত সরকার বিরোধী আন্দোলনে আবদুল জলিল তখন সংশপ্তক। দিন নেই রাত নেই তিনি ছুটছেন। ঢাকায় ১৪ দলের সভা শেষে নিজের হেভিওয়েট আর হেভি ডিউটির গাড়িতে করে ছুটছেন হয় চট্টগ্রাম, নয় রাজশাহী। ২৪ ঘণ্টা খোলা তার ০১৭১১৫২০৩৫৩ নম্বরটি। সংবাদের জন্য যখনি ফোন করেছি, তার আন্তরিকতা ভরা গম্ভীর ‘হ্যালো’ সম্বোধন! কোনও দিন, কোনও রাতে তাকে বিরক্ত হতে দেখিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়া স্থগিত করে দেশ গড়তে চলে আসেন তিনি। তারপর থেকে রাজনীতি দিয়ে দেশ সেবা, দেশ গড়াই ছিল তার ব্রত।
কী নঁওগা, কী ঢাকায় সবখানে, সব সময় মানুষের মাঝে বাঁচতে চাইতেন তিনি। গুলশানে তার বাসস্থানে যখনই গিয়েছি, তার বৈঠকখানায় দেখেছি অনেক অনেক মানুষ। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে শীতের এক সকালে তার নওগাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখেছি মানুষের মাঝেই বেঁচে আছেন তিনি। ব্যক্তিগত থেকে সামষ্টিক কোনও সমস্যা নিয়ে তার কাছে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে এমন উদাহরণ নেই বললেই চলে। আমাদের মতো গরীব মানুষের দেশে সত্যি সত্যি রাজনীতিবিদের অনন্য উদাহরণ তিনি। আর সাংবাদিকদের পরম আত্মীয় ছিলেন আবদুল জলিল। তার কাছে আমাদের আবদারের কমতি ছিল না কখনো। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো আমৃত্যু।
এমন একজন ভালো মানুষ রাজনীতিবিদকে অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে শেষ বেলায়। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামক যে দানবটির জন্ম হয় ২০০৭ সালে, তার চরম শিকার হন রাজনীতির সহজ মানুষ আবদুল জলিল। শারীরিকভাবে নানা জটিলতায় আক্রান্ত আবদুল জলিলকে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাচন চালায়। পরে তার নিজের দল আওয়ামী লীগেও নিগৃহের শিকার হন তিনি। একরকম কেড়ে নেওয়া হয় তার সাধারণ সম্পাদক পদ। কাউন্সিলর করে রাখা হয় উপদেষ্টা পদে যার কোনও ভূমিকাই নেই দলে। সেই থেকে অনেকটা অভিমানে একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকেন তিনি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই টুকুই পাওয়া। রাজনীতির এই বিশাল মানুষটি, গণতন্ত্রের জন্য রাজপথে লড়াকু এক চরিত্র, চলে গেলেন বাংলাদেশের এক বড় দুঃসময়ে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৩
জেডএম/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর