ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কমরেড হুগো চাভেজ, লাল সালাম

মনিরুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০১৩
কমরেড হুগো চাভেজ, লাল সালাম

মৃত্যু তার নয়, তিনি অযুত চাভেজ হয়ে ছড়িয়ে আছেন লাতিন আমেরিকার পথে প্রান্তরে, প্রতিটি লাতিনোর প্রাণের মাঝে। ভেনিজুয়েলার তিনবার নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান, তার চেয়েও বেশি হুগো চাভেজ ছিলেন সমগ্র লাতিন আমেরিকার গরিব ও শোষিত জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের ‘ফোক হিরো’।

তাঁর মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে ভেনিজুয়েলা। বানের জলের মতো রাস্তায় নেমে এসেছে সাধারণ মানুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। অঝোরে কাঁদছে। চাভেজ তুমি বেঁচে আছ, তুমি বেঁচে আছ বলে মাতম তুলছে। দুরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে দুই বছরের যুদ্ধে হেরে গেলেন এই মহান বিপ্লবী ৫৮ বছর বয়সে। গতকাল (বুধবার) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বাষ্পরুদ্ধ  কণ্ঠে জাতিকে জানালেন, “আজ আমি আপনাদের একটি ভয়ঙ্কর কঠিন খবর জানাব, আমদের প্রিয় কমান্দান্তে প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেছেন। ” তিনি স্পষ্ট করে বললেন যে, ২০১১ সালে চাভেজের ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পেছনে ভেনিজুয়েলার শত্রুদের কারসাজি আছে। এটা মূলত চাভেজের কট্টর শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার স্পষ্ট ইঙ্গিত। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।     

১৯৫৪ সালে সাবানেতা নামের ছোট্ট একটি গ্রামে হতঃদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চাভেজ। দারিদ্র্যতার কারণে ছোটবেলায় চাভেজ চলে আসেন মাতামহ রোজা চাভেজের কাছে রাজধানী কারাকাসে। চাভেজের প্রগতিশীল বাম আদর্শে দীক্ষা ও চেতনা বিকাশে ছিল রোজার ঐকান্তিক ভূমিকা ও প্রভাব। তখন ভেনিজুয়েলার রাজনীতিতে একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্রে উত্তরণের নামে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে ধনিক শ্রেণীর সরকার স্থায়ীভাবে গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সীমাহীন শোষণ ও দুর্নীতির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলে। শুধু শাসক ও ধনী ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করে তেল ও খনিজের মতো জাতীয় সম্পদ বৃহৎ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ইজারা দিয়ে লাগামহীন লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। হাই স্কুলে ছাত্রাবস্থায় এই অপশাসনের বিরুদ্ধে বাম প্রগতিশীল রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন চাভেজ।

খ্যাতিমান বেসবল খেলোয়াড় হিসাবে ১৮ বছর বয়সে ভেনিজুয়েলার সেনাবাহিনীতে যোগ দেন চাভেজ। সেনাবাহিনীতে লাতিন আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী মুক্তি আন্দোলনের মহান বীর সিমন বলিভারের অনুগামীদের সাথে তিনি যোগাযোগ ও রাজনৈতিক আলোচনা মাধ্যমে সতর্কতাসহ সংগঠিত হতে শুরু করেন। ১৯৮৯ সালে রাজধানী কারাকাসে সরকারবিরোধী ব্যাপক গণজাগরণ ঘটে। চাভেজ ও তাঁর সহযোগীরা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই অভ্যুত্থান সূচনালগ্নেই সরকার সমর্থিত সেনাবাহিনীর ব্যাপক আক্রমণের মুখে ব্যর্থ হয়ে যায়। চাভেজ বন্দী হলেন এবং দুই বছর পরে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে তিন কারাগার হতে মুক্তি পান।

মুক্তি পেয়েই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং জনগণকে শোষণ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিপ্লবের ডাক দেন। দারিদ্র বিমোচন ও সম্পদের সুসম বণ্টন, সবার জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আবাস এবং জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ ও জাতীয়করণ এই বিষয়সমূহ তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করলে দারিদ্র-ক্লিষ্ট সাধারণ জনগণের ভেতর ব্যাপক সাড়া জাগে। তিনি ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এর পরে ২০০০ সালে, ২০০৬ সালে এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। তাঁর এই দীর্ঘ শাসনকাল তিনি যেমন ঘরে বাইরে শত্রুদের সাথে লড়াই করে গেছেন অকুতোভয়ে, তেমনি তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন তাঁর বিপ্লবী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে চাভেজের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। চাভেজ ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি হন। এই সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এবং ভেনিজুয়েলার লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সামরিক ছাউনি অবরোধ করে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয় এবং ৪৮ ঘণ্টার ভেতর জনতা চাভেজকে মুক্ত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে।

মার্কিন তেল কোম্পানির লুণ্ঠন বন্ধ করে, তেল খনিজ প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে আজীবন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। তবে তাঁর দীর্ঘ ১২ বছরের শাসনামলের উজ্জ্বল কৃতিত্ব ও সফলতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ গোটা পৃথিবীর স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ স্বীকার করেছে যে, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান রাষ্ট্রসমূহের ভেতর ভেনিজুয়েলায়  অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য ন্যূনতম পর্যায়ে আছে। মার্কিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের ২০০৯ সালের রিপোর্টে চাভেজের এক দশকের শাসনের সফলতা অকপটে স্বীকার করেছে। তাদের মতে এই সময়ে ভেনিজুয়েলার জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতা ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, শিশু মৃত্যু হ্রাস পেয়েছে এক তৃতীয়াংশ, অপুষ্টিজনিত মৃত্যু ৫০ শতাংশ কমেছে, কলেজে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে তাঁর আমরণ সম্পর্ক ছিল প্রকৃতপক্ষেই গুরু শিষ্যের মতো। সদ্য নিহত লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি ও ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদের সঙ্গে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক।

চাভেজকে একজন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট বা শুদ্ধ সমাজতন্ত্রী ভাবা যায় না। তিনি ছিলেন সিমন বলিভারের সঠিক প্রতিচ্ছবি। লাতিন আমেরিকার উপযোগী তাঁর প্রতিষ্ঠিত পথকে তিনি নিজে বলতেন ‘বলিভারিয়ান বিপ্লব’। আর পশ্চাত্যের বৈরী মহল উপহাস-ছলে তাঁর আদর্শের নামকরণ করেছে ‘চাভিজমো’।   মূলত: গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে চাভেজ নির্মাণ করেছেন বিপ্লবের একটি অনবদ্য মজবুত বুনিয়াদ। বলিভারের আপসহীন মুক্তিকামী অনুপ্রেরণার ইতিহাস, অর্থনৈতিক সাম্যতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নিজস্ব কারিশমা—এই সব উপাদানের আনুপাতিক সংযোজনে সৃষ্ট তাঁর দর্শন। যে লাতিন আমেরিকার লড়াকু জনগণ দীর্ঘ যুগ ধরে অকাতরে রক্ত দিয়ে জীবনপাত করে বিপ্লব সফল করতে পারেনি, আজ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চাভেজের পথে তারা দেশে দেশে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি, বলিভিয়া, ইকুয়েডোর, গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, প্যারাগুয়ে—এই সব দেশের আকাশজুড়ে মানুষ বিজয়ের যে পতাকা উড়িয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে হুগো চাভেজের একক স্বপ্ন ও সংগ্রামের প্রতীক।

লেখক: কানাডা প্রবাসী, প্রাবন্ধিক।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৩
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।