ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কিসের আবার নারীদিবস !!

জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৩
কিসের আবার নারীদিবস !!

ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন কোনও তথাকথিত ঘোষিত দিবস পালন করিনা যা আমার মূল্যবোধ পরিপন্থী। বছরের একটা দিন ঘটা করে “মা দিবস”, “বাবা দিবস” কিংবা “ভালোবাসা দিবস” পালনে আমি যেমন ঘোর বিরোধী ঠিক, তেমনি ৩৬৫ দিনের মধ্যে একটি দিবসকে "নারী দিবস" পালনেও আমার ঘোর আপত্তি।



আমি নারী, আমি এতেই গর্বিত। আমি কখনোই পুরুষ হতে চাইনি। আমি মানুষ হতে চেয়েছি। আমার নারী স্বত্ত্বা থেকে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যকে বিসর্জন দিয়ে আমি পুরুষালী স্বত্ত্বা ধারণ করতে চাইনি। বরং নারী স্বত্ত্বার বিশেষ গুণগুলোকে আরও বিকশিত করে এগিয়ে গেছি।

বুকের ওড়না ছুড়ে ফেলে দিলেই নারী স্বাধীন হয়ে যায় না। শরীরে কাপড়ের মাত্রা কমিয়ে পুরুষের মত কাপড় পড়লেই নারী অধিকার আদায় হয় না। যতদিন রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটি দেশের মাঝে বিদ্যমান সকল উপযোগকে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ না করে নাগরিক অধিকার হিসেবে উন্মুক্ত করে না দেবে ততদিন এইসব লোক দেখানো দিবস পালন করে নারীর এগিয়ে যাবার পথে প্রতিবন্ধকতা দূর  হবে না।  

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সুতা কারখানার যে নারী শ্রমিকেরা মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন, আজ এই ২০১৩ তে এখনো বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই পুরুষের সমান কায়িক পরিশ্রম করেও পারিশ্রমিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দারুণভাবে বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন নারী শ্রমিকরা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যুগে যুগে এই দিনটিতে সভা-সমাবেশ করে কিংবা বক্তৃতা দিয়ে আদৌ নারীর অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়েছে কী?

আজ কী বিশ্বের  কোথাও কোনও নারী নির্যাতিত হবে না? আজ কী সকল নারী শ্রমিক তার পুরুষ সহকর্মীর সমান মজুরি পাবে? আজ কী নারী তার একঘেয়েমী জীবনের প্রাত্যহিক কাজ থেকে বিরতি নিতে পারবে?  আজ কী সব নারী মুক্তির স্বাদ পাবে? আজ এই একটা দিন কী সব নারী "মানুষ" বলে গণ্য হবে?

যদি না হয়, তবে কেন এই প্রহসনের বিশেষ দিবস উদযাপন?

নারীর আবার আলাদা কোনও অধিকার থাকবেই বা কেন? পুরুষেরই বা কী এমন আলাদা অধিকার থাকতে পারে? একটা দেশে নারী-পুরুষ সবাই নাগরিক মর্যাদা প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। কাজেই নাগরিক হিসেবে সবার সমান অধিকার থাকাটাই কাম্য। সেই অধিকার যাতে সকল নাগরিক ভোগ করতে পারে  তা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

আমি কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় নিরাপদে ফিরব কী না তা নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র যদি নারী-পুরুষ ভেদাভেদ না করে সকলের জন্য সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে তাহলে কিন্তু ঘরে বাইরে কোনও নারীকেই আলাদাভাবে কোনও অধিকার আদায়ের জন্য কোনও আন্দোলন করতে হয় না।

নারীর জন্য বাসের মধ্যে কয়েকটি সিট বরাদ্দ দিয়ে, নারী কোটায় চাকরি কিংবা সাংসদ বানিয়ে নারীর অধিকার নিশ্চিত হয় না বরং তা হয় নারীকে চরমভাবে অপমান করা। নারীর জন্য বাসের আলাদা কোনও সিট বরাদ্দের দরকার নেই, দরকার নেই কোনও নারী কোটা। শুধু সবার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক, নিশ্চিত করা হোক আইনের সঠিক ব্যবহার।

আমরা নারীরা নিজেরাই বাসের যেকোনো সিটে বসতে পারব..সিট না পেলে দাঁড়িয়ে যাব। নিশ্চিত করা হোক বাসে সিট না পেলে দাঁড়িয়ে গেলেও কেউ আমার শরীরে হাত দিয়ে যৌনসুখ খোজার চেষ্টা করবে না। ভিড়ের বাসে উঠতে না পারলেও দিনে-রাতের যেকোনো সময় আমি যাতে হেটে বাসা বা অফিস অব্দি পৌঁছাতে পারি সে নিরাপত্তা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করা হোক। সবার জন্য পড়াশুনা, চাকরি সবকিছু উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। নারী মেধা ও শ্রম দিয়ে সমাজে তার স্থান করে নেবে।

সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত হলে, সেই সঙ্গে প্রতিটি পরিবারে সকল সদস্যের সমান গুরুত্ব নিশ্চিত হলেই নারীর উপর সহিংসতাও কমে আসবে।

উনবিংশ শতাব্দীতে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত "নারী দিবস" যুগের পরিক্রমায় একজন নারীর জন্য আজ মারাত্মক অপমানজনক দিবস হিসেবেই গণ্য হয়। তাইতো উন্নত দেশগুলোর নারীরা আজ এই দিবস পালন করে না। দিবসটি পালন করা মানেই সমাজের মাঝে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে তোমরা নারী, তোমরা করুণার পাত্র, বছরের একটি বিশেষ দিন তোমাদের জন্য বরাদ্দ।

যেন মনে করিয়ে দেওয়া তোমরা বঞ্চিত, তোমরা নির্যাতিত, তোমরা নিষ্পেষিত শ্রেণীর। নারী দিবসে সমাজে বিরাজমান লিংগগত বৈষম্যকে যেন আরও প্রকট করে তোলে। বিশেষ দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে পুরুষ-নারীতে ভেদাভেদ করে নারীর জন্য আলাদা কোনও অধিকার অর্জিত হতে পারে না। বরং উভয়পক্ষের সহাবস্থান নিশ্চিত করেই মানুষ হিসেবে নিজেদের অধিকার আদায় করা যেতে পারে।

শতবর্ষ আগে জার্মানির ক্লারা যেমন নারীদের জন্য আলাদা একটি দিবসের জন্য দাবি তুলেছিলেন, সেই দিন বেশি দূরে নেই যেদিন শত শত নারীরাই এই দিবস বাতিল করার জন্য দাবি তুলবে। নারীদের কণ্ঠেই উচ্চারিত হবে, “লিঙ্গভেদে কোনও দিবস কারও জন্য নয়, বরং মানুষ হিসেবে সকলের অধিকার হবে সমান। ”

জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।