মনীষী লেখক ও দার্শনিক আহমদ ছফা বলেন, কবি-সাহিত্যিক-লেখকেরা গর্ভিনী নারীর মতো। তাঁরা জাতির গড়ে উঠার, বেড়ে উঠার, বেঁচে থাকার ভ্রুনকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন।
আজকের শাহবাগ গণজাগরণমঞ্চের নেতা-নেত্রী ও আমরা যারা নীরব সমর্থক আমাদের কারোরই সে সময়ে জন্ম হয়নি। তাই সেকালে কারা কবি, সাহিত্যিক ছিলো অথবা ছিলো না এবং তাঁদের মূল্যায়ন ছফাতেই সীমাবদ্ধ থেকে আমাদের আমলে যারা কবি, লেখক, চিন্তবিদ ও সাংবাদিক পরিচয়ে পত্রিকায় লেখেন ও টিভি টকশোতে অংশগ্রহণ করেন, আসুন তাদেরকে শাহবাগ গণজাগরণমঞ্চ নামক কষ্টিপাথরে কিঞ্চিৎ ঘষা দিয়ে দেখি।
সম্প্রতি আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলন করে শাহবাগ গণজাগরণমঞ্চ ও আন্তজার্তিক অপরাধ আদালত কর্তৃক যুদ্ধাপরাধের শাস্তির বিরোধীতা করেছেন। শুধু বিরোধীতাই নয়, অন্যায্য বলেছেন, প্রতিবাদে হরতালও দিয়েছেন।
জানা গেছে, সংবাদ সম্মেলন শুরুর খানিক আগে খালেদার সঙ্গে দেখা করেছেন কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহার। সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাংলায় লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে বাঙালী খালেদা জিয়া কয়েকবার হোঁচট খেয়েছেন।
৭১ টিভির টকশো দেখছিলাম ক’দিন আগে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির একজন নেতা যিনি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার খেলাধুলা বিষয়ক সাংবাদিকও। গণজাগরণমঞ্চের বিরোধীতা করায় আরো কয়েকজন প্রেসক্লাবকেন্দ্রিক সাংবাদিকের সঙ্গে তাকেও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় মঞ্চ থেকে। সংগঠনের বিধান ভেঙ্গে তিনি শাহবাগের বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন বিবৃতিতে অংশ নিয়ে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাওয়া এ সাংবাদিক যে টকশোতে কথা বলছিলেন তাতে বিখ্যাত সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাইও ছিলো।
বুলবুল ভাইকে উদ্দেশ্য করে আমার দেশের ওই সাংবাদিক বলছিলেন, দেখুন আজকের আমাদের ইনকিলাব কী লিখেছে ব্লগার রাজীবকে নিয়ে। [পাঠক লক্ষ্য করুন, আমারদেশ পত্রিকার বেতনভুক্ত সাংবাদিক দাবি করছেন তাদের ইনকিলাব] ব্লগার রাজীবকে নিয়ে ইনকিলাব ও আমারদেশসহ কয়েকটি পত্রিকার লেখা ও তার পরিণতির কথা সবাই জানেন। ইনকিলাব সত্যিই তাদের আছে, ছিলো ও থাকবে!
কবি ও লেখক ফরহাদ মজহারের ঘনিষ্ঠ আরেকজন একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক ইসলামিক ও দিগন্ত টিভির একাধিক টকশো’তে শাহবাগ গণজাগরণমঞ্চের তরুণদের বিরোধীতায় নিমজ্জিত থাকার খবর পাই এক সহকর্মীর কাছ থেকে। সত্তরোর্ধ এ কলাম লেখক দেশের একটি বিখ্যাত পরিবারের সন্তান। [এখানে তার নাম না লেখতে পারায় ক্ষমাপ্রার্থী]।
হিজবুত তাহরীর জন্মের প্রথম দিকে জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনের এসাইনমেন্টে গিয়ে ফরহাদ মজহারের ঘনিষ্ঠ উক্ত কলামিস্টকে সম্মেলন মঞ্চে দেখতে পাই। দু’তিনটি সংবাদ সম্মেলন ও কর্মসূচি ঘোষণার পর হিজবুত তাহরীর কী জিনিস তা স্পষ্ট হয়ে যায় সাংবাদিক ও রাজনীতির পরিমণ্ডলে।
ক’দিন আগে সংবাদ সম্মেলনের খানিক আগে খালেদার সঙ্গে ফরহাদ মজহারের সাক্ষাত। সত্তরোর্ধ সাংবাদিক-কলামিস্টের টকশোতে শাহবাগের বিরোধীতা ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনার সুবিধার্থে দুটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করছি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ২০০০ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে ৪৫ মিনিট সময় দিয়েছিলেন ক্লিনটন। সাক্ষাতের সময়ের ব্যপ্তি বেশি হওয়ায় সরকারি মহলের কয়েকজনকে উদ্বিগ্ন দেখেছিলাম।
জেনেছিলাম ক্লিনটনের সামনে আড়াই পৃষ্ঠার হাতে লেখা ইংরেজির একটা লিখিত বক্তব্য পড়তে বারকয়েক হোচঁট খেয়েছিলেন খালেদা। কয়েকটা প্যারাগ্রাফ বাদ দিয়ে ওই বক্তব্যের কপি অন্য হেডিংয়ে ছাপা হয়েছিলো বিএনপি সমর্থিত একটা ইংরেজি পত্রিকায়।
ক’দিন আগে আমেরিকার অখ্যাত পত্রিকা ওয়াশিংটন টাইমসে খালেদার একটা লিখিত বক্তব্য নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছে। খালেদা দেশপ্রেমিক নন বরং অস্থিতিশীলতায় উস্কানিদাতা, অনেকে এমন ধারণা পেয়েছেন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত খালেদার নিবন্ধে।
জানামতে, তিন/চারটি প্যারাগ্রাফবাদে মূল সুরে প্রায় মিল আছে ক্লিনটনের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় খালেদাপঠিত ইংরেজি বক্তব্যের সঙ্গে সম্প্রতি প্রকাশিত খালেদার নিবন্ধের।
২০০০ সালে ক্লিনটনের সফরের কিছুদিন আগেই সুবিচার নামের একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিলো। অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ফরহাদ মজহার। সদস্য ছিলেন, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, নাম না লেখা বিখ্যাত পরিবারের সাংবাদিক-কলামিস্ট, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কন্যা রিটা রহমানসহ কয়েকজন। এ সংগঠনে যোগ দিতে ছফাকে দাওয়াত জানিয়েছিলেন ফরহাদ মজহাররা। বিনীতভাবে প্রত্যাখান করেছিলেন তিনি।
বিখ্যাত লেখক ও অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের একটি লেখা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে পড়লাম। ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মুজাফফর আহমদের একটা লেখার বরাতে খালেদা ও ফরহাদ মজহারের আসল চেহারা উন্মোচন করেছেন তিনি।
আহমদ ছফার একটা গর্বের বিষয় ছিলো তিনি কয়েকমাসের জন্য এ বিখ্যাত নেতা মুজাফফর আহমদের রাজনৈতিক পিএস হতে ও থাকতে পেরেছিলেন। শিক্ষিত হয়েও ফরহাদ মজহারের নির্বোধের মতো কাণ্ড ঘটানো এবং মার্জারের স্বভাবের প্রসঙ্গ টেনেছেন সলিমুল্লাহ খান।
আমি ওদিকে যাবো না কারণ, শাহবাগ গণজাগরণমঞ্চের নগদ ও সুদূরপ্রসারী সাফল্যের মধ্যে অন্যতম সাফল্য দেখেছি আমাদের কালের অনেক বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিকের আসল চেহারার উন্মোচন। শাহবাগ নামক কষ্টি পাথরে যাচাইয়ে তারা ধরা খেয়েছেন। সাম্প্রদায়িক যারা তার সব সময়ই সাম্প্রদায়িক। ছদ্মবেশী মৌলবাদীর চেহারা খুলে দিয়েছে শাহবাগ মঞ্চ।
২০১৩ সালে সংবাদ সম্মেলনের আগে খালেদার সঙ্গে ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎ, খালেদার দেশবিরোধী লেখা আমেরিকার পত্রিকায় ছাপা হওয়া, সিনিয়র সাংবাদিক-কলামিস্টের দিগন্ত টিভিতে জাগরণমঞ্চের মুণ্ডুপাত করা, আমার দেশ পত্রিকার সংবাদিকের আমাদের ইনকিলাব বলা।
ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়কের আমলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার সময় আমলাদের পক্ষে নগ্নভাবে মৌলবাদী পত্রিকায় ফরহাদের কলাম লেখা। আবার ৯৯ সালে সুশৃংঙ্খল মানুষদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরির লক্ষে উসকানিমূলক লিফলেট ছাপা ও বিলি, খালেদার মুখে দেশবিরোধী বুলির ইংরেজি অনুবাদ ক্লিনটনের সামনে পাঠ করানো, সুবিচার নামক সংগঠন তৈরি করে ক্লিনটনের কাছে স্মারকলিপিতে নিজ দেশকে ছোট করা ইত্যাদি একসূত্রে গাঁথা। এতে অন্তত আমি অবাক হইনি কারণ আমি ১৭ বছর আগে ছফার লেখা পড়েছিলাম।
ছফা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নামক বইয়ে লিখেছেন, যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবি করে থাকেন তাঁদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।
আমার মনে হয় জাগরণমঞ্চের আগমন ছফা বর্ণিত প্রগতিশীলদের দশভাগের সঙ্গে ৯০ ভাগ যোগ হবে। ৪২ বছর বয়স্ক বাংলাদেশে বাঙালী জাতির নতুন করে গড়ে উঠার, বেড়ে উঠার, বেঁচে থাকার ভ্রুনকণা অন্তর্লোকে ধারণ করার মতো প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের এগিয়ে এসে চিহ্নিত শতভাগ মৌলবাদীদের দ্বিশতভাগ মূলোৎপাটনও হবে।
সিদ্দিকুর রহমান খান: ছফার শ্রুতি লেখক। নিউ এইজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর