ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ফরহাদ মজহারের বুদ্ধিবৃত্তিক চালাকি

ফাহমিদুল হক, ঢাবি শিক্ষক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১০ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৩
ফরহাদ মজহারের বুদ্ধিবৃত্তিক চালাকি

কবি, প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার শাহবাগ আন্দোলনের প্রায় তিন সপ্তাহ পর, নিজ বক্তব্য নিয়ে হাজির হন। টেলিভিশন টক-শোতে কথা বলা শুরু করেন সাঈদীর বিচারের রায়ের আগমুহূর্তে আর পত্র-পত্রিকায় বেশুমার লেখা শুরু করেন সাঈদীর রায়-পরবর্তী সংঘাতে মৃত্যুর ঘটনার পর; যাকে তিনি রাষ্ট্রের বা হাসিনার ‘গণহত্যা’ বলে বর্ণনা করেছেন।

আন্দোলকারীরা বা আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি ব্লগাররা অনলাইনে খুব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন আন্দোলনের প্রথম সপ্তাহেই, সবাই সংহতি জানাতে আসছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বা অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ আসছেন না কেন? আমার অবশ্য কৌতূহল ছিল ফরহাদ মজহার কেন নিশ্চুপ তা জানার জন্য, অপেক্ষা করছিলাম এই আন্দোলনকে তিনি কীভাবে দেখছেন তা শোনার জন্য। তিনি দেরীতে এলেন, কিন্তু প্রবলভাবেই এলেন। দিগন্ত টিভি, একুশে টিভি, নিজের অনলাইন পত্রিকা চিন্তা, ‘বন্ধু’ মাহমুদুর রহমানের পত্রিকা আমার দেশ-এর পর, মঙ্গলবার (৫ মার্চ, ২০১৩) লিখলেন ইত্তেফাক পত্রিকায়। আমি তার ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত রচনা ‘নির্মূলের রাজনীতি’-তে যে বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছেন, তার প্রতিক্রিয়াই লিখবো এখানে।

ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের অন্যতম সক্রিয় বুদ্ধিজীবী। মার্কসবাদ থেকে ইসলাম, গণিত থেকে বাংলার ভাবান্দোলন Ñ বিচিত্র বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য। শুধু লেখনী নয়, বৈঠকী আড্ডা, সক্রিয়তা-সংগঠনের মাধ্যমে তিনি তৈরি করেছেন শিষ্যকূল, যারা আবার বাংলাদেশের অধুনা ইন্টেলিজেন্সিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজেও ফরহাদ মজহারের অনেক চিন্তা ও কর্ম দ্বারা উদ্দীপিত হয়েছি, কখনো কখনো প্রভাবিতও হয়েছি। আমার দিক থেকে অবশ্য শিষ্যত্ব গ্রহণ বা পরিচিত হবার কথা কখনো মাথায় আসে নি। বলা যায়, সমাসাময়িক বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেছেন, কেউই তাকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। তার গুণমুগ্ধ অনুসারীর সংখ্যা যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অংশ হিসেবে তাকে আক্রমণ বা বাতিল করতে উৎসাহীর সংখ্যাও অনেক।
যাহোক, ফরহাদ মজহারের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যাবে, তিনি সবসময় উল্টো স্রোতের যাত্রী হতে চেয়েছেন। তার মতাদর্শিক শিফটের অনেক প্রমাণও রয়েছে, তার কৃতকর্মেই। তবে আজ তিনি শাহবাগবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন উল্টো স্রোতে সাঁতার কাটার জন্য নয়। বরং ইতিহাসের বাঁকে কোনো কোনো ঘটনা উপস্থিত হয়, যখন তত্ত্ব-ভাব-কূহক-রেটরিক দিয়ে আলোচনা আগানো যায় না, স্পষ্ট অবস্থান নিতে হয়। ফরহাদ মজহার আন্দোলনের তৃতীয় সপ্তাহে এসে বুঝিয়ে দিলেন তিনি শাহবাগবিরোধী। তিনি ইত্তেফাক-এর লেখায় এই আন্দোলনকে বলেছেন ‘শেখ হাসিনার শাহবাগী তামাশা’। তার বিএনপি-সংশ্লিষ্টতার কথা সর্বজনবিদিত ছিল, এই আন্দোলন-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি এও স্পষ্ট করলেন যে, প্রয়োজনে তিনি জামায়াত-শিবিরের কার্যকলাপের ব্যাখ্যাকার হিসেবে হাজির হতে পারেন, তবুও তিনি মানতে রাজী থাকবেন না যে ৫ থেকে ১০ লাখ লোক মাসব্যাপী আন্দোলনে যে শাহবাগে যাওয়া-আসা করেছেন, তাতে বহুমাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল, কেবলমাত্র শেখ হাসিনার ‘সাজানো নাটকের’ জোকার সাজতে যাননি তারা। তার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চলন তাকে বাধ্য করেছে শাহবাগবিরোধী অবস্থান নিতে। বিএনপি-জামায়াতের বিগত জোট সরকারের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য উপদেষ্টা-পরামর্শদাতার ভূমিকাটি এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। যে আমার দেশ তার অনৈতিক সাংবাদিকতা দিয়ে হীন উদ্দেশ্যে এক ব্লগারের নাস্তিক পরিচয় সব আন্দোলনকারীর সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মীয় উস্কানি-উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল, ফরহাদ মজহার সেই পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে নিজের বন্ধু বলে দাবি করেছেন, সেখানে প্রকাশিত হওয়া সাম্প্রতিক এক লেখায়। বিগত জোট সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানের প্রশ্রয়ে যে জ্বালানি-দুর্নীতি হয়েছে দেশে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও কমিউনিস্ট ফরহাদ মজহার তাকেই বন্ধু ভেবে গর্বিতবোধ করছেন। বুদ্ধিজীবিতার সঙ্গে মতলববাজি যুক্ত হলে এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তার শিষ্যদের কাউকে কাউকে গুরুর এই অবস্থানগ্রহণ দেখে লজ্জিত হতে দেখছি।        

ফরহাদ মজহারের মতো আমিও মনে করি, জামায়াতের মতাদর্শের বিরুদ্ধে মতাদর্শিকভাবে লড়বার প্রয়োজন আছে। এই কাজটি রাজনৈতিক কাজ, চিন্তা দিয়ে মোকাবিলা করার কাজ, বুদ্ধি দিয়ে পরাস্ত করবার কর্তব্য। আমাদের এটাও ভুললে চলছে না যে বিএনপি প্রবলভাবে এবং আওয়ামী লীগ মৃদুভাবে জামায়াতকে প্রশ্রয় দিয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে। শাহবাগের তরুণদের কোনো রাজনৈতিক ধান্দা নাই, তারা জামায়াতকে সরাসরি নিষিদ্ধ করার পক্ষে, এবং এইভাবে তারা বড় দুই দলকে স্পষ্ট বার্তাও দিচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, এটা কোনো সহজ কাজ নয়, মতাদর্শিকভাবে ও চিন্তা দিয়ে জামায়াতকে মোকাবিলার কাজটি এর আগে ধারাবাহিকভাবে ও সঙ্গতিপূর্ণভাবে কেউ করে নি। তবে ফরহাদ মজহার জামায়াতকে মতাদর্শিকভাবে মোকাবিলার কথাটি বলার জন্যই বলেছেন, আপাতত তিনি জামায়াত শিবিরকে রক্ষা করার জন্যই মাঠে নেমেছেন। এমনকি এর আগে ২০০৪-০৫ সময়কালে আবির্ভূত জঙ্গিবাদের সঙ্গে সরল-প্যাশনেট ইসলামপ্রিয়তার কোনো সৎ যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। ফলে তিনি যখন জঙ্গিবাদকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনায় নিচ্ছিলেন, তাকে আমরা এককথায় উড়িয়ে দেইনি। বুঝতে চেয়েছি কোন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আর্থ-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট জঙ্গিবাদের জন্ম দেয়। কিন্তু জামায়াত-শিবিরকে আমরা সবাই ভালোভাবি চিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জামায়াত কী বস্তু, তা আমরা সকলেই জানি।    

ইত্তেফাক-এর রচনায় ফরহাদ মজহারকে পাওয়া গেল জামায়াত-শিবিরের সবচাইতে সমব্যথী নাগরিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে। তিনি লিখলেন, “আবুল কালাম আযাদ ও কাদের মোল্লার রায় দেখে জামায়াত-শিবির পরিষ্কার হয়ে গেল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব। ... তদুপরি শাহবাগে ফাঁসির দাবির জন্য গণজাগরণের মঞ্চ খোলা ও তার প্রতি সকল প্রকাল রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও দলীয় সমর্থন দেখে জামায়াত-শিবির বুঝে নিল বলপ্রয়োগের পথ গ্রহণ করা ছাড়া জামায়াত-শিবিরের সামনে কোনো গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক বা আইনি পথ খোলা নাই। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবার জন্য তাকে বলপ্রয়োগের পথে যেতে হোল”।

জামায়াত কেন সহিংস হলো তিনি সেটা সহানুভূতির সঙ্গে বুঝতে পারছেন, কিন্তু সেই সহিংসতার অংশ হিসেবে কেন হিন্দু বাড়ি-উপাসনালয়ে হামলা করা হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা তো দূরের কথা, উল্লেখ পর্যন্ত করছেন না। জামায়াত যদি ‘বলপ্রয়োগের পথে যায়’ তবে শাহবাগের আন্দোলকারীদের কী করা উচিত? তারা অহিংসই থেকেছে, বড়জোর ফ্যাসিবাদী দলের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী স্লোগান দিয়েছে ‘‘শিবির ধর, জবাই কর’’। আর এই পরিস্থিতিতে সরকারপক্ষ কি তার বাহিনী নিয়ে পাল্টা বলপ্রয়োগে যাবে? সম্ভবত এর উত্তর হবে, হ্যাঁ। তাই হয়েছে, অনেক মানুষ মরেছে, একশর কাছাকাছি। এর মধ্যে জামায়াত-শিবির কর্মীর সংখ্যাই বেশি, আছে সাধারণ মানুষও, আওয়ামী লীগ কর্মী আছে, আছে পুলিশও। অনেক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তির বিনাশ হয়েছে। টানা হরতালে জনজীবন অচল হয়েছে। অবশ্যই যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষের মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত, নিন্দনীয়, বেদনাদায়ক। একেই বিএনপি-জামায়াত এবং ফরহাদ মজহার বলছেন ‘গণহত্যা’। এর প্রতিবাদ করছেন তিনি। মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবী তিনি, তিনি এর প্রতিবাদ করবেনই। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের বিপরীতে সংখ্যালঘু মানুষদের আক্রমণ কি অতি সামান্য অপরাধ? একদমই না। এইক্ষেত্রে তিনি নিশ্চুপ কেন?

আমি শেখ হাসিনার অনুরাগী নই, আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনুসারীও নই ‘‘আমি পাঁচ তারিখ বিকেল চারটায় শাহবাগে গিয়েছি, এরপর প্রায় প্রতিদিনই একাধিকবার গিয়েছি। তিনি যখন একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে বলেন ‘শেখ হাসিনার শাহবাগী তামাশা’, আমি তার প্রতিবাদ করবোই। তিনি তার সংকীর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান দিয়ে শাহবাগকে বিচার করছেন। তিনি আন্দোলনের তিন সপ্তাহের মাথায় তার ‘ট্যাগিং মেথড’ নিয়ে হাজির হয়েছে। শাহবাগ আন্দোলন মোটেই সরকারের সাজানো নাটক নয়। মনে রাখতে হবে পাঁচ ফেব্রুয়ারির বিকেলে যেই শখানেক মানুষ জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিল, তারা সরকারের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিল। তারা মনে করেছিল, সরকার ও জামায়াতের মধ্যে সম্ভবত একটা আঁতাত হয়েছে, নইলে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলার পাঁচটি প্রমাণ হলেও ফাঁসি না হয়ে যাবজ্জীবন কেমন করে রায় হয়? অন্য সবার মতো সরকারও হতভম্ব হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশের প্রকৃতি বুঝতে প্রথম দু’তিনদিন পার করে দিয়েছে। সরকারের সাজানো নাটক হলে আওয়ামী লীগ নেতা হানিফকে প্রজন্ম চত্বরে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না। এরপর সরকার বুঝতে পেরেছে এই আন্দোলনকে সমর্থন দেয়া দরকার, আখেরে তাদেরই লাভ। এ এক অদ্ভূত পরিস্থিতি! মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদির প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ ইতিবাচক নম্বর পাবেই, ঐতিহাসিক বাস্তবতা তাকে এই সুবিধা দেয়। চার বছর ধরে বহুল অপশাসনের পরও শাহবাগ আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি-ব্যর্থতার ইস্যুগুলোকে আপাতত পর্দার আড়ালে লুকাতে সাহায্য করেছে। ফলে প্রকাশ্য না হলেও, অপ্রকাশ্য সমর্থন সরকার প্রথম দুই সপ্তাহ দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ২১ তারিখের মহাসমাবেশের পর থেকে ছাত্রলীগ সামনের সারিতে চলে আসে, এবং সরকারপক্ষের অংশগ্রহণ প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। বিএনপির জন্যও এই পথ খোলাই ছিল, কিন্তু বিএনপির জামায়াত-সখ্য, বা জামায়াতনির্ভরতা ইদানীং অতি তীব্র। ফলে সিঙ্গাপুর থেকে খালেদা জিয়া ফিরে নিজের মধ্যপন্থী দলটিকে স্থায়ীভাবে আরও ডানে নিয়ে গেলেন।

ফরহাদ মজহার লিখেছেন, “একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। মানবতার বিরুদ্ধে তাদের অনেকে জড়িত ছিল এবং তার বিচার হওয়া দরকার, এব্যাপারে কোনই সংশয় বা সন্দেহ নাই”। আবার একই রচনায় তিনি বলছেন, “আবুল কালাম আযাদ ও কাদের মোল্লার রায় দেখে জামায়াত-শিবির পরিস্কার হয়ে গেল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব। কারণ রায় রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হবে”। এই স্ববিরোধিতার মানে কী? জামায়াত বা ফরহাদ মজহার এখানে কী ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছিলেন? কয়েক মাসের জেল অথবা কয়েক লক্ষ টাকা জরিমানা? তাহলে মোল্লাদের যুদ্ধাপরাধের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের ন্যায়বিচার হবে কোন আদালতে? তিনি লিখছেন, “শাহবাগীরা অভিযুক্তদের যে কোন প্রকারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে চায়”। তাদের নিরন্তর ‘ফাঁসী চাই’ স্লোগানে তিনি যারপরনাই বিরক্ত। ঠিক তাই, শাহবাগীরা সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিই চেয়েছে, নির্বাচনী হিসেব-নিকেশের সমঝোতা-রায়ের সম্ভাবনাকে তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। কাদের মোল্লার রায়ে সম্ভবত আদালতকে প্রভাবান্বিতই করা হয়েছে; জনমানুষের সমর্থন আদালতকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে, তাই সাঈদীর রায় জনগণের প্রত্যাশামাফিক হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হবে, এটাই ন্যায়বিচার।  

ফরহাদ মজহার তার লেখার শেষদিকে মারাত্মক একটা কাজ করে বসলেন। তিনি সাঈদীর রায়-পরবর্তী জামায়াত-শিবিরের ‘বলপ্রয়োগ’ কর্মসূচিকে তাত্ত্বিকভাবে ‘গণমানুষের বিদ্রোহ’ বলে বর্ণনা করার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, সাঈদীকে চাঁদে দেখা, নাস্তিকদের আন্দোলন, আল্লাহ-রসুলকে অবমাননা ইত্যাদি মিথ্যাচার দিয়ে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হয়েছে জামায়াত। তাতেই কি এটা ‘গণমানুষের বিদ্রোহ’ হয়ে গেল? সেক্ষেত্রে লাখ লাখ ‘শাহবাগী’কে তিনি গণমানুষ বলতে রাজি হবেন না? তার ধূর্ততার বাড়বাড়ন্ত দেখা গেল জামায়াতের প্রতিবাদকে ‘শ্রেণিবিদ্রোহ’ হিসেবে চালান করার উদ্যোগে। তিনি লিখছেন, “দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী কোন শ্রেণির প্রতিনিধি সেটা এই রায় ঘোষণার পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ... লড়াই মধ্যবিত্তের পরিসর থেকে গ্রামীণ খেটেখাওয়া গরিব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। রাজনীতির গুণগত উল্লম্ফন ঘটে গেল। শহরের বিরুদ্ধে গ্রামের গরিব জনগণের বিদ্রোহের একটি পটভূমি তৈরি হোল। ” কথাগুলো মার্কসীয় শোনালেও এ এক ধরনের চালাকিমাত্র। মার্কসবাদে আমাদেরও আস্থা-আগ্রহ আছে, গরিব মানুষের মুক্তি আমরাও চাই। কিন্তু কোনো ভুল ব্যাখ্যা বা আরোপিত শ্রেণিবিদ্রোহের কথা আমরা শুনতে চাই না। আমরা জানতাম ফরহাদ মজহার একইসঙ্গে লেনিনবাদ ও চৈতন্য-লালনের লোকধর্মের অনুসারী, যাকে তিনি বলেন বাংলার ভাবান্দোলন। ফলে সুফি ইসলাম বা জনপ্রিয় ইসলাম তার কাছে প্রশ্রয় পাবার কথা। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি সুফি ইসলামের বিপরীত মতাদর্শ রাজনৈতিক ইসলামের তাত্ত্বিক ও রক্ষাকর্তা হিসেবে হাজির করেছেন। বিষয়টি আমাদের অবাক করে। অথবা তার আওয়ামীবিরোধিতা স্থূল পর্যায়ে চলে গিয়েছে। ফলে একটি প্রগতিবিরুদ্ধ, পশ্চাৎপদ-ফ্যাসিস্ট ও যুদ্ধাপরাধীদের দলের পক্ষে তিনি দাঁড়াচ্ছেন, সংঘাতের তত্ত্বায়ন করছেন। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে যদি আমরা দেখি জামায়াতের পক্ষ থেকে এই চালাকির চাপ তিনি বিএনপির ওপর ফেলছেন “বাংলাদেশের রাজনীতিতে আস্তে আস্তে বেগম খালেদা জিয়া ও তার বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছিল। এখন তার কঠোর অবস্থান তাকে হয়তো সাময়িক রক্ষা করবে, কিন্তু তিনি যদি গণমানুষের এই বিদ্রোহ থেকে দূরে সরে থাকেন, তাহলে শেষ রক্ষা হবে কিনা এখনও বলা যায় না”।

ফরহাদ মজহারের এই অবস্থানগ্রহণ আমাদের হতবাক করে, বিক্ষুব্ধ করে।
 
ফাহমিদুল হক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।