জামায়াত নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কি হারিয়ে যাবে? এই দলের ইতিহাস তা বলে না। আদালতের নির্দেশেই হোক, অথবা সরকারের নির্বাহী আদেশ; জামায়াত নিষিদ্ধ হলে সম্ভাব্য কয়েকটি বিকল্প:
১. সংবিধান অনুযায়ী দেশে ধর্মীয় রাজনীতি যেহেতু নিষিদ্ধ না, তাই অন্য নামে নতুন দল গঠন করতে পারে জামায়াত।
২. গোপন দল হিসেবে জামায়াত থেকে যেতে পারে, প্রকাশ্যে তারা যোগ দিতে পারে বিএনপিতে; যেমনটি কমিউনিস্টরা পাকিস্তান আমলে ন্যাপের মাধ্যমে করেছেন।
৩. জামায়াত পুরোপুরি গোপন দল হিসেবে কার্যক্রম চালাতে পারে, সেক্ষেত্রে তারা এমন নাশকতার পথ বেছে নিতে পারে যাতে সরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তাদেরকে আবারও জামায়াত নামে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়।
কি হলে কি হবে, কি হলে কি হতে পারেÑÑ এরকম আলোচনার সুযোগ অবশ্য এখন কম; কারণ জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়া না হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরিই আদালতের এখতিয়ার চলে গেছে, এরইমধ্যে তার শুনানি শুরু হয়ে মুলতবি হয়েছে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। শুনানি যেহেতু শুরু হয়ে গেছে তাই আগে এর মীমাংসা না হলে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকার বিবেচনায় নিতে পারছে না। যদি আদালত শেষ পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে, তারপরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকার নিশ্চয়ই একদিকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এবং কিছুটা হলেও তার রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নেবে। সেই সিদ্ধান্ত জানার আগে তাই অপেক্ষা কিছুটা করতেই হচ্ছে।
নিষিদ্ধ হলে জামায়াত কি করবে, কি করবে না সেই পূর্বাভাস অবশ্য এরইমধ্যে পাওয়া গেছে। নিষিদ্ধ না হলেও একাত্তরে তাদের ভূমিকার কারণে জনপ্রতিরোধের মুখোমুখি হলে প্রকাশ্য এবং নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল হওয়ার পরও জামায়াত কি করতে পারে সাঈদীর রায়ের পর তাও প্রমাণ হয়েছে।
আরও কিছু ঘটনার সঙ্গে অনেকে প্রমাণ হিসেবে জয়পুরহাটের ঘটনা উল্লেখ করছেন, যেখানে সাঈদীর রায়ের পর সহিংস বিক্ষোভে পাঁচবিবি উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের জামায়াতের সেক্রেটারি মোহাম্মদ ফোরকান নিহত হন। প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুযায়ী এলাকার এক ছাত্র ফোরকানের সঙ্গে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জানান, সেদিন মিছিল শান্তিপূর্ণ হবে বলেই দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো। কিন্তু পাঁচবিবি থানার পাশে গিয়ে কিছু লোক থানা আক্রমণ করে বসে। ওই ছাত্রের ভাষ্যমতে, ফোরকান আক্রমণকারীদের বাধা দেন। সেসময় একটি গুলি তার পায়ে লাগে। এরপর আরও দুটি গুলি লাগে ফোরকানের বুকে এবং পেটে।
এই ঘটনায় অনেকে বলছেন, পুলিশ যখন উত্তেজিত জনতার মধ্যে গুলি করতে বাধ্য হয় তখন সেই গুলির সুনির্দিষ্ট টার্গেট থাকে না। তাই একজনের পায়ে গুলি লাগার পর আবারও বুকে এবং পেটে গুলি লাগার সম্ভাবনা শূণ্য। আর টার্গেট করেই যদি পুলিশ গুলি করবে তাহলে পুলিশ কেনো সেই লোকটিকেই গুলি করবে যে থানার ওপর হামলায় বাধা দিচ্ছে?
তাই পুলিশের বদলে বরং অভিযোগের আঙুল ওঠছে জামায়াতের দিকেই। যারা এরকম অভিযোগ করছেন তারা বলছেন, ওই মিছিলে জামায়াত নিশ্চয়ই সশস্ত্র ছিলো, লাশ ফেলে দেওয়ার নির্দেশনা ছিলো তাদের ওপর। তাই তারা তাদের মধ্যে তাকেই বেছে নিয়েছে যে থানায় আক্রমণের বিপক্ষে ছিলো। এতে একদিকে যেমন থানায় আক্রমণের বাধা দূর হয়েছে, তেমনই তাদের লাশের সংখ্যাও বাড়ানো গেছে।
যতোই দিন যাচ্ছে ততোই স্পষ্ট হচ্ছে সাঈদীর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় লাশের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মরিয়া ছিলো জামায়াত-শিবির। নেতা-কর্মীদের মৃত্যুর জন্য তৈরি করেই মিছিলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেই মৃত্যু পুলিশের গুলিতেই হোক, কিংবা নিজ থেকে; জামায়াতের লক্ষ্য ছিলো একটাইÑÑ যতো বেশি সংখ্যক লাশ।
প্রথম আলোর আরও একটি রিপোর্টে তা স্পষ্ট হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী রাজশাহীর গোদাগাড়িতে ৩ মার্চের সংঘর্ষে নিহত হয় ১৫ বছর বয়সী রফিকুল ইসলাম। স্থানীয় আয়েশা সাবের দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলো রফিক। সংঘর্ষের দিন অন্য অনেক মাদ্রাসার মতো আয়েশা সাবের দাখিল মাদ্রাসার ছাত্রদেরও আগেই ছুটি দেওয়া হয়।
রফিকুল ইসলামের বাবা গোলাম মোস্তফা এবং মা সতুরা খাতুন বলেছেন, ‘ছেলে যাওয়ার সময়ই বলে গেছে সে শহীদ হতে যাচ্ছে। ছেলের মৃত্যুতে আমাদের কোনো কষ্ট নেই। তার মাধ্যমে আমরা বেহেশতে যাবো। ’
ওই মাদ্রাসার শিক্ষক রফিকুল ইসলামের বোনের জামাই আব্দুর রাজ্জাক। তিনিও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেন, তার শ্যালকের শহীদী মরণ হয়েছে। তাই তাকে গোসল ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। তারা কোনো মামলা-মোকদ্দমাও করবেন না।
এভাবে উস্কানি দিয়ে ‘শহীদী মরণে’র লোভ দেখিয়ে মাদ্রাসার শিশু-কিশোরদের সাঈদীকে বাঁচানোর মিছিলে নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। হয় তাদের উস্কানি দিয়ে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়, কয়েকজনের মৃত্যু হয়; অথবা পুলিশের গুলিতে কেউ মারা না গেলে ভেতর থেকে গুলি করে কয়েকজনকে মেরে ফেলা যায়।
শুধু জয়পুরহাট কিংবা রাজশাহী নয়, জেলায় জেলায় জামায়াত মাদ্রাসার কোমলমতি গরিব শিশুদের বিভ্রান্ত করে মিছিলে নামিয়েছে, ‘শহীদী মরণে’র কথা বলে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ অবস্থায় নিয়ে গেছে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের অভিজ্ঞতা বলে, মাদ্রাসার শিশু এবং নারীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহারের কারণে পুলিশ প্রথমে কোনো অ্যাকশনে যেতে পারেনি। এর ফল তারা পেয়েছে পুলিশ সদস্যদের নিহত হওয়ার মতো ঘটনা দিয়ে।
ঘটনার কয়েকদিন পর সবকিছু যখন ঠা-া মাথায় বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তখন স্পষ্ট হচ্ছে অবুঝ শিশু-কিশোরদের ধর্মের নামে আত্মঘাতি করে ফেলেছে জামায়াত। আফসোসের বিষয়, রফিকের মতো মাদ্রাসার ছাত্ররা ভেবেছে ইসলামের জন্য শহীদ হওয়ার মিছিলে নেমেছে তারা। কিন্তু আসলে এটা ছিলো জামায়াতকে বাঁচানোর মিছিল, যে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের অভিযোগ প্রমাণিত। শিশুরা মিছিলে নেমে জীবন পর্যন্ত দিয়েছে, কিন্তু তারা ইসলামের নামে জামায়াতের ইসলাম এবং নেতাদের আসল রূপের কিছুই জানে না।
জাহিদ নেওয়াজ খান: সংবাদকর্মী (znewaz@gmail.com)