সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতার ভিড়ে ভালো কোনো খবর নজরে আসে না। নজরে আসে নিরীহ স্বজনের লাশের খবর, মন্দিরের ভেতর টুকরো হয়ে পড়ে থাকা ধর্মীয় বিশ্বাস আর সংখ্যালঘু স্বজনের পৈত্রিকভিটা ভাঙচুরের খবর।
এমতাবস্থায় যখন শ্বাস নেয়াই দুষ্কর হয়ে পড়ে তখন আমাদের সকলের মাঝে এক রাশ প্রশান্তি নিয়ে এসেছে দল-মত নির্বিশেষে সকলের প্রিয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। রাজনৈতিক নোংরা খেলা আর দেশকে স্থবির করে দেয়া হরতালের ডামাডোলে আজ আমরা পেয়েছি বিশ্বকাপজয়ী শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ শ্রীলংকা দলের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ ড্র করার সুখবর।
দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অনেকগুলো রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য দেশে-বিদেশে সকল বাঙালির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম তোমাদের জানাই অভিনন্দন।
আমরা সবাই জানি যে, আমাদের প্রিয় দলের প্রায় প্রত্যেক সদস্যই এসেছেন মফস্বল শহরের খোলামেলা প্রান্তর থেকে। ছোটকাল থেকেই খেলাধুলার পরিবেশ পেয়েই তারা কৈশোরে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কেউ গিয়েছেন বিকেএসপিতে কেউবা ঘরোয়া মাঠে খেলেই শানিয়ে নিয়েছেন নিজেদের প্রতিভা। রাজনীতি, মাদকাসক্তি, বিকৃত রুচি, ধর্মান্ধতা কোনো কলংকই আমাদের প্রিয় দলের কোনো সদস্যকেই স্পর্শ করতে পারে নাই। তাদের নিজেদের পিতামাতার সাথে সাথে তাই আমরা সকলে ওদের নিয়ে গর্ব করি। বাবা-মায়েরা নিজেদের সন্তানকে সাকিব-মুশফিকের মতো গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখার সাহস পান। কিন্তু চাইলেই কি যান্ত্রিক এই শহুরে জীবন-যাপনে খেলোয়াড় সন্তান গড়ে তোলা সম্ভব?
নামকরা খেলোয়াড় গড়ে তোলার কথা না হয় বাদই দিলাম, একথা আমরা সবাই জানি যে খেলাধুলা শুধু মানুষের শরীরের জন্যই উপকারী তা নয়, মনেরও অনাবিল প্রশান্তির খোরাক। রাজধানীসহ বড় বড় শহরে বসবাসরত শিশু কিশোরদের খেলাধুলার স্থানাভাবে বাসায় বসে টিভি আর কম্পিউটারের সামনে অবসর সময় কাটিয়ে দেয়। খুব অল্প বয়সেই তাদের বিভিন্ন ধরনের গেমস আর ফেসবুকের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। এভাবে চার দেয়ালের মাঝে যন্ত্রের সাথে সখ্যতা দিয়ে আদৌ কি একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব?
প্রবল ইচ্ছে থাকলেও অভিভাবকদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথাও মুক্ত বাতাসে খেলতে নিয়ে যাবার জো নেই। মাদকাসক্ত, ভ্রাম্যমাণ পতিতা আর মতলববাজ লোকের আনাগোনার কারণে পার্কে নিয়ে গিয়ে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার কথা কেউ চিন্তাও করে না। তাছাড়া অকারণেই গাদা গাদা বই আর ছেলেমেয়েদের সব বিষয়ে পারদর্শী করে তোলার অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে ইদানিং মফস্বল শহরগুলোতেও খেলাধুলার মাঠ থাকলেও বাবা-মায়েরা সন্তানদের খেলতে দিতে তেমন উত্সাহী হন না।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ছেলেরা যাও কিছুটা খেলার সুযোগ পায়, মেয়েদের সে সুযোগ নেই বললেই চলে। ছোটকাল থেকেই মেয়েদের বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার উপযোগী করে গড়ে তোলার চেষ্টায় প্রায় প্রতিটি বাবা-মা-ই নিয়োজিত থাকেন। এছাড়াও এ সমাজে মেয়েদের উপর যৌন হয়রানির ভয় তো আছেই।
খেলাধুলার কথা না হয় বাদই দিলাম, ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করার চাপে শিশুদের মনগঠনের জন্য বিভিন্ন ধরনের গল্প-উপন্যাস, ইতিহাস পড়ার কথাও যেন বাবা-মায়েরা কল্পনাও করতে পারেন না। তাহলে শরীর ও মনের বিকাশ হবে কিভাবে?
ঘরে ঘরে মাদকাসক্তি আর আত্মকেন্দ্রিক ছেলেমেয়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি ছাড়াও সাম্প্রতিককালের কিছু ঘটনা লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে, এ প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ ভয়াবহ আস্তিক ও ভয়াবহ নাস্তিক ক্যাটাগরিতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। হুজুরের কাছে আম-ছিপারা আর হুজুরের সাথে মিলে অর্থ না বুঝে কোরান খতম দিলেই কি শিশু ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যাবে? প্রকৃত জ্ঞানের অভাবেই কৈশোর উত্তীর্ণ হবার সাথে সাথে সেইসব শিশুদের সহজেই ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ইসলাম রক্ষার জেহাদি কিংবা আধা শিক্ষার কারণে ধর্মহীন হয়ে গড়ে উঠছে।
আজ যখন বাংলাদেশ দলের জনাকয়েক সোনার সন্তান আমাদের আনন্দে ভাসিয়ে দেয়, বদ্ধ পরিবেশে কিছুটা সুখের ছোয়া দেয়, তখন গভীরভাবে উপলব্ধি করি যন্ত্রের সাথে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কথা। মুক্তবাতাসে মুক্ত ও সুস্থ চিন্তার প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাইলে খেলাধুলার থেকে ভালো কোনো পন্থা হতে পারে না। দেশের ভালো-মন্দের দেখভাল করার শপথ নিয়ে যারা আমাদের পয়সায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে খেলা উপভোগ করছেন, সুস্থ একটা প্রজন্ম গড়ে তুলতে খেলাধুলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে সেই নীতিনির্ধারকেরা এগিয়ে আসবেন কি?
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" এ এমএস শেষ করে বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৩