উপরের প্রথম ছবিটি বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সকলেই দেখেছেন। দ্বিতীয় ছবিটি পত্রিকায় প্রকাশিত এবং আমার পিএইচডি গবেষণায় এই ছবিটি আমি বিশ্লেষণ করছি।
এবার আসি দ্বিতীয় ছবিটির প্রসঙ্গে, লক্ষ্য করুন, একটি টেস্ট-টিউবের ভিতরে একটি হাসিখুশি নবজাতককে দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটি আঁকা হয়েছে কিংবা ডিজিট্যালি ম্যানুপুলেট করা হয়েছে। তবে এর অর্থ তৈরি করার বিষয়টি সাঈদীর ছবি চাঁদে বসানোর মতোই। । আইভিএফ পদ্ধতিতে চিকিৎসকেরা পেট্রি ডিসে শুক্রানু আর ডিম্বানুর মিলন ঘটান, যেখান থেকে এম্ব্রায়ো তৈরি হয় এবং এই এম্ব্রায়ো কোন নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়, গর্ভবতী হওয়া সফল হলে এই এম্ব্রায়ো পরিপূর্ণ শিশুতে পরিণত হয় নারীর জরায়ুতে এবং সবশেষে নবজাতকের জন্ম হয়। সুতরাং, কোন শিশু টেস্ট টিউবে পরিপূর্ণ অবয়ব পায় না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন করতে হয় ছবির টেস্ট-টিউবে শিশু এলো কেমন করে? যখন এই চিত্রায়ন সত্য নয়, তখন প্রশ্ন ওঠে এরকম ছবি পত্র্রিকায় দেওয়া হলো কেন?
সংবাদপত্রের এই নির্দিষ্ট (উল্লিখিত ছবিটি সহ) ফিচারটি টেস্ট-টিউব পদ্ধতির সার্থকতাকে প্রাধান্য দিয়ে লেখা। ধারণা করি এই টেস্ট টিউবের ভিতরে এম্ব্রায়ো না দেখিয়ে একটি শিশু দেখানো হয়েছে সন্তান প্রত্যাশী নারী পুরুষকে আইভিএফ পদ্ধতি গ্রহণে প্রলুব্ধ করতে। অপরিচিত আনুবীক্ষণিক এম্ব্রায়ো (যা আসলে এই প্রক্রিয়ায় টেস্ট টিউবে সৃষ্টি হতে পারে) সন্তান প্রত্যাশী নারী পুরুষের কাছে ততটা আবেদন রাখতে পারে না যতটা পারে একটি শিশু। সেকারণেই হয়তো শিশুটির ছবি টেস্ট টিউবে বসানো হয়েছে। এতে নারী পুরুষেরা আইভিএফ পদ্ধতিতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, ও পদ্ধতিটি গ্রহণ করবে, ফলে আইভিএফ ক্লিনিকগুলো ক্রমাগত ক্লায়েন্ট পাবে ও এতে তাদের মুনাফা তথা তাদের ব্যবসা নিশ্চিত হবে। অথচ আইভিএফ পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যায়বহুল ও সার্থকতার হার মাত্র ২০ ভাগ। অর্থাৎ এই প্রসিডিউর গ্রহণকারীদের ৮০ ভাগই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করেও কোন সন্তান লাভ করেন না। আমরা আমাদের সমাজ ও সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিচারে কি এই ক্লিনিকগুলোর মুনাফার সমর্থনে করা ফটোগ্রাফের ম্যানিপুলেশনকে যথাযথ বলতে পারি? এতে কার লাভ ও কার ক্ষতি?। এখানে বিজ্ঞাপনের কনস্ট্রাকশন প্রাসঙ্গিক।
মডেল সিন্ডি ক্র্যাফোর্ড বিজ্ঞাপনে তাঁর নিজের ছবি দেখে বলেন- ‘আহা আমি যদি সিন্ডি ক্র্যাফোর্ডের মতো হতাম’। কারণ তাঁর বিজ্ঞাপনের সৌন্দর্য ফটোশপের মাধ্যমে বানানো সৌন্দর্য। তখন বিজ্ঞাপনের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে হয়। এমনি এমনি সিন্ডি এটি বলেননি, পাশ্চাত্যের নারী যেন বিজ্ঞাপনের নারী শরীর থেকে প্রলুব্ধ হয়ে ডায়েট করে করে এনোরেক্সিক না হয়ে ওঠেন, সেই সাবধানতা উচ্চারণ করতে এই সত্য প্রকাশ করেছেন তিনি। পুঁজিবাদের আধিপত্য বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে সকল আপত্তিকে খেয়ে দিব্যি টিকে থাকছে। তা বলে বিজ্ঞাপন সমর্থন যোগ্য হয়নি, সেকারণে এর রাজনীতি উন্মোচন জরুরি ভিত্তিতে করা হচ্ছে।
একই বিচারে সাঈদীর চাঁদে মুখ বসানো ও মসজিদে ঘোষণা দিয়ে জনগণকে সাঈদীর জন্য পথে নামিয়ে দেওয়াটাকে কি সমর্থন করা যায়? সামাজিক গবেষক ও ইতিহাসবিদগণ গুজব/রিউমার নিয়ে নানা কাজ করেছেন। গুজব অনেকমসয় প্রান্তিক মানুষজন অধিপতিকে মোকাবেলার জন্য ব্যবহার করে। যেমন অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রসঙ্গে বাচ্চা চুরি হওয়া ও সেই বাচ্চার কিডনি তুলে নেওয়ার গুজব ল্যাটিন আমেরিকায় দেখা যায়, এ গুজব আমাদের দেশেও আছে। এই গুজব দিয়ে প্রবলকে প্রান্তিক নিরন্তন অস্বস্তির মধ্যে রাখে। মনে রাখা প্রয়োজন, এই গুজব প্রান্তিক মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হলে একে তার লড়াইয়ের কৌশল হিসাবে বিবেচনা করা যায়। ভাবা প্রয়োজন, সাঈদী প্রসঙ্গে গুজব কি স্বতঃস্ফূর্ত প্রান্তিক/সাবঅল্টার্ন মানুষজনের? নাকি এটি শহুরে/গ্রামের মধ্যবিত্তেরই তৈরি করা। আশা করি, কুতর্ক করতে করতে কেউ বলবেন না যে এখন বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষজন কম্পিউটারের ফটোশপেও পারদর্শী!
অন্যদিকে এই গুজব প্রান্তিক জনগণের কোন প্রান্তিকতাকে মোকাবেলার জন্য? স্পষ্টতই একটা রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা, যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে এই গুজব ছড়ানো হয়েছে। কথা হলো এই দলটি কি আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষের রাজনীতি করে? সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকের পাশে কি কখনও তাদের দাঁড়াতে দেখেছি আমরা? নাকি তারা পুড়ে যাওয়া গার্মেন্টস শ্রমিকের পরিবারের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে? কানসাট ও ফুলবাড়ির কথা না হয় নাই বল্লাম। ৪২ বছর ধরে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও দাপুটে রাজনীতিক সাঈদী কি বাংলাদেশের সমাজে প্রান্তিক? সাঈদী ধর্মের ব্যাখ্যা দিত, আবেগে জনগণকে ভাসিয়ে দিতে পারত হয়তো, কিন্তু গরীব মানুষের কোন মৌলিক বঞ্চনা মোচনে সাঈদী বা তার দল তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে?
মানতে হয়, বাংলাদেশে যারা শ্রেণীর রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন, তারা গরীব বাঙালি মুসলমানকে যথাযথ মূল্য দেন নাই, প্রান্তিকের চৈতন্যকে ‘নিজেদের উচ্চতর’ অবস্থান থেকে নানা সময়ে অবহেলা করেছেন। আরও মনে করি, কোরাআনের বাণী প্রচার ও তার তাফসির ধার্মিক পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ করতেই পারেন। কিন্তু সাঈদী তার ওয়াজে নারী বিদ্বেষী যৌনবাদী ব্যাখ্যা দিতেন, তা কিভাবে সমর্থন করি? তার ব্যাখ্যার নির্দিষ্ট রাজনীতি তো স্পষ্ট। কী করে না বিবেচনা করি যে, তিনি তার ওয়াজে মুসলমানের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে স্পষ্টত অন্যান্য ধর্মের মানুষকে খাটো করতেন, স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতেন (কেউ চাইলে ইউটিউবে সার্চ করে শুনতে পারেন তার বক্তব্য), সর্বোপরি তাকে সমর্থন করা যায় না কারণ তিনি ৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী। ফলে তাকে বাঁচানোর রাজনীতিও সমর্থন করা যায় না।
ছবি সূত্র : ছবি-১ : ফেসবুক থেকে পাওয়া, ছবি-২ : দৈনিক যুগান্তর (০৪.০৮.২০০৬)
[মির্জা তাসলিমা, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
বাংলাদেশ সময় : ১৪০৪ ঘণ্টা, ১৩ মার্চ ২০১৩
সম্পাদনা : এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর