প্রতি বছরের মতো এবারও ৮ মার্চ বেশ ঘটা করে পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে এ দিবসটি।
নারী দিবস উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে সরকারের লেঠেল বাহিনীর দমন-পীড়ন।
পরে ১৯০৮ সালে ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের পর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালন করতে থাকে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
এ হচ্ছে নারী দিবস পালনের অধিকার। কিন্তু প্রতিবছর যেমন ঘটা করে পালিত হয় নারী দিবস তেমনি দিনদিন বেশ ঘটা করে অবমাননা করা হয় নারীকে।
নারী সম-অধিকার তো দূরের কথা অনেক সময় নূন্যতম অধিকারটিই পায় না। নারীর নেই নিরাপদে পথ চলার অধিকার, নারীর নেই তার মেধা ও মনন বিকাশের অধিকার, নারীর নেই মত প্রকাশের অধিকার। আর পরিবার ও সমাজিক কাঠামোর এ অধিকারহীনতা নারীকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে। এর ফাঁকে নারীকে অধিকার ও স্বাধীনতা দেওয়ার নামে নারীকে করে তুলেছে পণ্য।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই নারী ঘরের পাশাপাশি বাইরে কাজ করছে। এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তির মূলে যে কৃষি তারও উদ্ভব নারীর হাতেই। কালক্রমে নারী বন্দী হয়েছে চার দেয়ালের নাগপাশে।
এখন আবার এ অবস্থা থেকে নারীদের মুক্তি দেওয়ার নাম করে নারীর মেধা ও মনননের অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। নারীদের পরিণত করা হচ্ছে ভোগ্য পণ্যে, তাকে বানানো হচ্ছে যৌন সামগ্রী।
মানুষের মানবিক মূল্যবোধ যাতে চরম ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। অথচ আমরা আমাদের চারপাশে নারীদের হয়তো এমন রূপ বা পরিবেশে কখনো দেখিনি। সৌন্দর্যের ধারণার সঙ্গে যেমন ফর্সা শব্দটি জড়িত তেমনি কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন মানেই যেন নারী। এমনকি নারীরা যেসব পণ্য ব্যবহার করেন না এমন সব পণ্যের মডেল হিসেবে দেখানো হয় নারীকে।
বাস্তবে এমন অভিজ্ঞতা কি কারও হয়েছে যে কোনো পুরুষ বডি স্প্রে মাখলে সমুদ্র পার হয়ে আসে এমনকি আকাশের পরীরাও পৃথিবীতে নেমে আসে। এখানে নারীকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে চরমভাবে। নারীকে এখানে সরাসরি কামুক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক-ই কি নারী তাই? নাকি বিপরীত? এর পেছনে একটাই কারণ হতে পারে নারীকে পুঁজি করে পণ্যের কাটতি বাড়ানো।
আর বর্তমানে একটি বেসরকারি মোবাইল অপারেটরের আলোচিত বিজ্ঞাপনের ভাষ্য- ‘আপনার ফিরে আসার গুরুত্ব আর কেউ না বুঝলেও আমরা বুঝি’ শুনলেই মনে পড়ে ছোটবেলায় শোনা একটা প্রবাদ ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’র- কথা। এ দরদের পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে। আর তাও পণ্যের কাটতি। কিন্তু বাস্তবে কি এমন হয় যে হারানো প্রিয়জন ফিরে আসলে তাকে বুকে জড়িয়ে না ধরে এভাবে মূল্যায়ন করা হয় কিংবা প্রিয়জনের চেয়ে লবণের মূল্য বেশি। মানুষের ভোগবাদিতা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালে মানবিক বা পারিবারিক সম্পর্কের চেয়ে ভোগ্যদ্রব্যের মূল্য বেশি। এখানেও ভোগবাদী হিসেবে নারীকেই দেখানো হয়েছে।
আবার নারীর একমাত্র গুরুত্ব যেন তার সৌন্দর্যতেই নিহিত। একটি ক্রিমের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় এজন নারী যিনি ঘরে ও বাইরে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেন। হঠাৎই তিনি একদিন আবিস্কার করলেন তার সহধর্মী তার দিকে নজর দিচ্ছে না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি দেখলেন তার লাবণ্য কমে গেছে, মুখে পড়েছে ক্লান্তির ছাপ। এরপর আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি নামি কোম্পানির ক্রিম ব্যবহার শুরু করেন যথারীতি তার সহধর্মীটিও তার প্রতি নতুন করে আকৃষ্ট হন এবং দ্বিতীয়বার মধুচন্দ্রিমায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তিনি। একজন নারী যার ঘর এবং বাইরের কাজের কোনো মূল্য নেই তার সহধর্মীর কাছে আছে শুধু বাহ্যিক সৌন্দয্যের গুরুত্ব।
এরপর আসি একটি নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনে। সেখানেও একই অবস্থা। চুল শুষ্ক এবং রুক্ষ হয়ে গেলে প্রিয় সহধর্মী আর ফিরেও তাকাচ্ছে না। নারকেল তেল মাখার পর চুল স্বাস্থ্যজ্জ্বল হয়ে উঠলে নারীটি তার সহধর্মীকে জিজ্ঞেস করেন- ‘ভাল লাগে!’ সহধর্মীর উত্তর- ‘লাগে, লাগে!!’
বিশ্বায়নের এ যুগে নারী স্বাধীনতার নাম করে নারীকে বাইরে বের করে অনেকটা নগ্নভাবেই বাজারজাত করা হচ্ছে। কিন্তু নারী স্বাধীনতা মানেই নারীদের অর্ধ-নগ্ন করে র্যাম্প মডেলিংয়ের নামে শরীর প্রদর্শনী নয়। মডেলিং দেখে মনে হয় না এগুলো কোনো পোশাকের প্রদর্শনী। আর এ ধরনের পোশাক কোনো বাংলাদেশি নারী পরেন কিনা আমার জানা নেই।
আবার কোনো মোটর কোম্পানির নতুন মডেলের কোনো বিলাসবহুল গাড়ি বাজারে আসলে বা গাড়ি বিক্রয় বা প্রদর্শনীর জন্য রাখা হলে সেখানেও গাড়ির সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় নারীদের। দেখে মনে হতেই পারে ‘গাড়ি কিনলে নারী ফ্রি’।
এ তো গেলো বিজ্ঞাপন ও মডেলিংয়ের কথা খেলার মাঠেও একইভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে নারীরা। খেলার মাঠে যারা যান তারা শুধুমাত্র খেলা দেখতেই যান, সেখানে ‘চিয়ার্স গার্ল’-দের ভূমিকা কী? কেন রাখা হয় তাদের? নাকি সেখানেও দর্শক আকর্ষণের হাতিয়ার হিসেবে নারীকেই বেছে নেওয়া হয়!
আবার অনেক সময় অজান্তেই প্রচলিত রীতিতে বিয়ের কনে দেখানোর নাম করে নারীদের এক ভাবে প্রদর্শনই করা হচ্ছে। সেখানেও মূল্যায়ন করা হচ্ছে না নারীর মেধা ও মননকে। এখানে মানা হয়- আগে ‘দর্শনধারী পরে গুণ বিচারী’ প্রবাদটি। বর পক্ষের পছন্দের উপর নির্ভর করতে হয় কনে পক্ষকে। এমন কি হয় ছেলেদের যোগ্যতা না দেখে শুধু তার বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে তাকে বর হিসেবে নির্বাচন করা হয়? হয় না। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা অহরহ হচ্ছে। এথানেও অবমূল্যায়িত হচ্ছে নারী।
এভাবে ঘর থেকে বাইরে নানাভাবে নানা উপায়ে, সচেতন বা অবচেতনে অবমূল্যায়িত হচ্ছে নারী। আমি কোনো ক্ষেত্রেই কোনো বিজ্ঞাপন দাতা সংস্থার নাম উল্লেখ করলাম না। তাদের কাজ তারা করে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন কিংবা নারীবাদের ধুয়ো তোলেন তাদের চোখে এ বিষয়গুলো কি একেবারেই পড়ে না! নাকি তারা বুঝতেই পারেন না বিষয়গুলো দিয়ে নারীদের অধিকার, তাদের সামাজিক মর্যাদাকে খর্ব করা হচ্ছে। নাকি তারা নিজেরা চুপ করে থাকেন এ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দেওয়া অর্থেই নারীদের জন্য তারা কাজ করেন। যদি এ ভয়েই তারা মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন তাহলে নারীদের জন্য কাজ করার আসল উদ্দেশ্য কি ব্যাহত হয় না? বছরের একটা দিন শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে মাতামাতি না করে ঘর থেকে বাইরে যাতে নারী তার যোগ্যতা অনুযায়ী মেধা ও মননের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাতে পারে সে বিষয়ে সচেতন থেকে এবং নারীকে পুরুষের অর্ধাঙ্গী না ভেবে পরিপূর্ণ মানুষের মর্যাদা দেওয়াই নারী দিবস ও নারীদের জন্য করা কাজের উদ্দেশ্য হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৩
আরআর/ eic@banglanews24.com