বিএনপি তখন কোথায় ছিলো? খালেদা জিয়ার কথামতো জনতার প্রতিরোধে বিএনপি যোগ দেয়নি? বিএনপি কি তাহলে জনবিরোধী দল? নাকি সবকিছু তছনছ করে দিয়ে জামায়াত ক্ষমতার রসগোল্লা মুখে পুরে দেবে, আর নয়াপল্টনের দোতলার বারান্দা থেকে খালেদা জিয়া পায়ে হেঁটেই সরাসরি বঙ্গভবন গিয়ে শপথ নিয়ে নেবেন, এই আশায় ছিলো বিএনপি?
খালেদার প্রতিরোধের তত্ত্ব আর বিদেশিদের সঙ্গে বিএনপির আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ‘প্রতিরোধের ওই সংগ্রামে’ বিএনপির না থাকার দাবিতে অনেকে প্রশ্ন করছেন, খালেদা জিয়ার ডাকে কি তাহলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সাড়া দেননি? বিষয়টা বুঝতে একটু পেছন ফিরে দেখা যাক।
সাঈদীর ফাঁসির আদেশের সময় হাঁটু এবং দাঁতের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে ছিলেন খালেদা জিয়া।
যে নেতারা জানেন না নেত্রীকে কখন ফুল দিয়ে স্বাগত জানাতে হয়, আর কখন কালো ব্যাজ পরে; তারা নেত্রীর অনুুপস্থিতিতে যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না সেটাই স্বাভাবিক। তাই ধরে নেওয়া যায়, সাঈদীর ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবির কর্মীরা যখন জেলায় জেলায় তা-ব শুরু করেছে, তাতে বিএনপি কর্মীদের কি ভূমিকা হবে তা কেন্দ্রীয় নেতারা ঠিক করে দেননি কিংবা দিতে পারেননি। এটাও ধরে নেওয়া যায়, যেসব জায়গায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, সেখানে তারা হয়
১. দলের স্থানীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তে, অথবা
২. ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে, কিংবা
৩. জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির যে আদর্শিক সম্পর্ক তাতে বিএনপিকে আজ না হলেও কাল মাঠে নামতে হবে; এরকম ব্যবহারিক তত্ত্বের আগাম বাস্তবায়নে জামায়াত-শিবিরের তা-বে যোগ দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা ঢাকা মহানগরী শাখার স্থায়ী আহ্বায়ক হিসেবে সাদেক হোসেন খোকারা সিদ্ধান্ত না নিতে বা না দিতে পারলেও ঢাকার বাইরে অনেকে ভুল করেননি। বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার ওই সৈনিকরা বীর বিক্রমে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছেন। দলীয় অবস্থানে তারাই যে ঠিক ছিলেন একদিনের মাথায় তার প্রমাণ দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার স্ত্রী।
দেশে ফিরে ১ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে ‘প্রতিরোধ’ গড়ে তোলার ডাক দেন। তার সেই ‘প্রতিরোধে’র আহ্বানের পর নতুন শক্তিতে থানা-পুলিশ-সরকারি স্থাপনা-বিদ্যুত কেন্দ্র এবং সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। প্রথম দিনের তা-বের জন্য শুধু জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করা গেলেও বিএনপি চেয়ারপার্সনের আনুষ্ঠানিক ‘প্রতিরোধে’র আহ্বানের পর বিএনপিকেও আর এর বাইরে রাখা যায় না। খালেদা জিয়ার নিজের বক্তব্যই তার প্রমাণ।
বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ মার্চ একটি বিবৃতি দেন খালেদা জিয়া। সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন: “ব্যর্থ ও গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পেশি ও অস্ত্রশক্তির ওপর নির্ভরশীল সরকারের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন-নিপীড়ন এবং নির্বিচার হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ যখন ফুঁসে উঠে প্রতিরোধের লড়াই শুরু করেছে, সেই মুহূর্তে বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা আমরা জানতে পেরেছি। ”
এখানে খালেদা জিয়া যে ‘প্রতিরোধের লড়াই’ শুরু হওয়ার কথা বলেছেন, ১ মার্চ সেই ‘প্রতিরোধে’র ডাক তিনিই দিয়েছিলেন। শুধু জামায়াত-শিবির নয়, নেত্রীর আহ্বানে ওই প্রতিরোধে বিএনপি কর্মীদেরও যোগ না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। ‘প্রতিরোধের এই লড়াই’ নিশ্চয়ই ‘আপোষহীন’ খালেদা জিয়া এবং তার দলের জন্য বিশাল এক গৌরবের বিষয়। কারণ ৪ মার্চের বিবৃতিতেই তিনি বলেছিলেন: “....... বিভিন্ন সময় গণবিচ্ছিন্ন শাসকেরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে জনগণের আন্দোলনকে বিপথগামী করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। স্বৈরশাসকদের এহেন ঘৃণ্য তৎপরতাকে নস্যাৎ করে দিয়ে অতীতে আমরা জনগণের আন্দোলনকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছি। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না ইনশাআল্লাহ্। ”
খালেদা জিয়া এভাবে প্রতিরোধের নতুন লড়াইকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও তার দল অন্ততঃ বিদেশিদের সামনে প্রতিরোধের গৌরবের লড়াইয়ে বিএনপির ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছে। ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় খালেদা জিয়া যখন শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর মতো পল্টন অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দলের নেতা-কর্মীদের সামনে বক্তৃতা করছিলেন, তখন বিদেশিদের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সহিংসতার প্রতিরোধের লড়াইয়ে তাদের কোনো ভূমিকা থাকার কথা অস্বীকার করছিলেন কয়েকজন নেতা।
বিএনপির আমন্ত্রণেই বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী। এছাড়াও চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান এবং সাবেক সচিব সবিহউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। প্রায় দেড় ডজন দেশের কূটনীতিকরা বৈঠকে যোগ দেন। তবে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেউ ছিলেন না।
পরের দিনের সংবাদপত্রের খবর, “জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের পর সহিংস অবস্থার বিষয়ে কূটনীতিকরা জানতে চান। বিএনপি নেতারা বলেছেন, এসব সহিংসতার সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা নেই। ” এভাবে যে সহিংসতাকে খালেদা জিয়া ‘প্রতিরোধের লড়াই’ বলেছিলেন, কূটনীতিকদের সামনে বিএনপি নেতারা তাকে সহিংসতা বলে স্বীকার করেন। প্রতিরোধের লড়াই বলে খালেদা জিয়া গৌরবের যে নতুন অধ্যায়ের কথা বলেছিলেন, তাতে বিএনপির সব ধরণের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন দলের নেতারা।
তবে বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে যে কথাই বলুক, ১ মার্চের সংবাদ সম্মেলন এবং ৪ মার্চের বিবৃতির মতো বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন খালেদা জিয়া। কূটনীতিকদের সামনে তার দলের নেতারা যখন সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছিলেন, তখন নয়াপল্টন অফিসের বারান্দা থেকে দেওয়া বক্তৃতায় খালেদা জিয়া বলছিলেন: “এ সরকারকে এখন আর সময় দেওয়া যায় না। সরকার একদিকে আমাদের মিছিল-মিটিংয়ে গুলি করছে, অন্যদিকে ‘বিধর্মী নাস্তিক’দের পাহারা দিয়ে, খাওয়া-দাওয়া দিয়ে লালন করছে। ... ... এই যে মঞ্চ ফঞ্চ বানাচ্ছেন আর পাহারা দিচ্ছেন, এসব বন্ধ করুন। না হলে জনগণের মঞ্চ যখন তৈরি হবে তখন আর কেউ আপনাদের বাঁচাতে পারবে না। ”
সরকার একগুঁয়ে হলে যে কেউ বাঁচাতে পারে না, সেই অভিজ্ঞতা অবশ্য খালেদা জিয়ার নিজেরও আছে। ৯৬’র ১৫ ফেব্রুয়ারির একদলীয় নির্বাচনের পর, প্রবল আন্দোলনের মুখে নয়াপল্টনে এরকমই একটি সমাবেশ থেকে বঙ্গভবনে গিয়ে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেদিন তার শুভবুদ্ধির প্রশংসা করেছিলেন সবাই। সাধারণত: তিনি নয়াপল্টন অফিসে না আসলেও বুধবার যে প্রেক্ষাপটে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন, সে কারণেও তার জন্য অনেকের সহানুভূতি ছিলো। ২০০৪ সালে তার সরকারের সময় যেভাবে পুলিশ আওয়ামী লীগ অফিসে ‘হানা’ দিয়েছিলো, নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করেছিলো; ঠিক একই কায়দায় এবার তার অফিসে পুলিশি ‘হানা’ এবং নেতা-কর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানাতে পল্টন অফিসে এসেছিলেন বেগম জিয়া। যদিও অফিসের ভেতরে ককটেল-বোমা উদ্ধারের মতো ঘটনা ঘটেছে, তারপরও যে কেউই রাজনৈতিক দলের অফিসে পুলিশের এরকম অ্যাকশনের নিন্দা জানাবেন। সেজন্য এই ইস্যুতে খালেদা জিয়ার জন্য সহানুভূতি আছে অনেকের।
কিন্তু তিনি যেভাবে গণজাগরণ মঞ্চকে ‘বিধর্মী এবং নাস্তিক’ বললেন তাতে কাকে কোন্ উস্কানি দিলেন তিনি? তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চয়ই না জানার কথা না যে তিনি আঙুল উঁচিয়ে কাউকে ‘বিধর্মী’ বললে সাম্প্রদায়িক শক্তি কি বার্তা পায়!
এক সপ্তাহ সময় নিলেও তিনিই না শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চকে স্বাগত জানিয়েছিলেন! তাদের কাছে না যুদ্ধাপরাধের বিচার ছাড়াও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনর্বহালসহ আরও অনেক দাবি তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন! তখন তাদেরকে ‘বিধর্মী-নাস্তিক’ মনে হয়নি! খালেদা জিয়া যাদের কথার প্রতিধ্বনি করছেন, তারা আজ না হলেও আগামীকাল কিন্তু বলতে পারে, হিজাব ছাড়া শাড়িতে নারীদের বাইরে আসা না-জায়েয, নারী নেতৃত্বও হারাম।
জাহিদ নেওয়াজ খান: সংবাদকর্মী (znewaz@gmail.com)
বাংলাদেশ সময় ১১০২ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৩