অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের নাম আমি শুনি ২০০৫ সালে, আমার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ বইটি লেখার সময়। বইটির পঞ্চম অধ্যায়টির ওপর কাজ করছিলাম।
দুঃখ পাবার যৌক্তিক কারণ তো আছে। আমি ভাবতাম মহাবিশ্বের কপালে ঠিক কি আছে এগুলো নিয়ে চিন্তাভাবনা আর ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং, ফাইনম্যান, অ্যালেন গুথ, মাইকেল টার্নার, লরেন্স ক্রাউসের মতো দুনিয়া কাঁপানো বিজ্ঞানীরাই। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলামের মতো বিজ্ঞানীরাও যে এ নিয়ে কাজ করেছেন, এবং কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেসের মতো প্রকাশনা থেকে বই বের করছেন, সেটা জানা সে সময় শুধু আমাকে আনন্দ দেয়নি, রীতিমত অবাক করে দিয়েছিল। আরো অবাক হলাম যখন জানলাম বইটি নাকি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্ব, ক্রোয়েটসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আমার অবাক হবার পাল্লা বাড়তেই থাকল যখন জানলাম, এই নিভৃতচারী বিজ্ঞানীর কেবল একটি নয় বেশ কয়েকটি ভালো ভালো বই বাজারে আছে। ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন রিলেটিভিটি’, ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি’, এবং ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামের কঠিন কঠিন সব বই। বইগুলো আমেরিকার বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পড়ানো হয়। বাংলাতেও উনার একটা বই আছে ‘কৃষ্ণবিবর’ নামে। বাংলা একাডেমী থেকে একসময় প্রকাশিত হয়েছিল।
আমি ততদিনে উনার কাজকর্ম সম্বন্ধে জানতে শুরু করেছি। জানলাম, উনি লন্ডনস্থ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়-এর অ্যাপ্লায়েড ম্যাথেমেটিক্স অ্যান্ড থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছিলেন ১৯৬৪ সালে। সাধারণত একাডেমিক লাইনে থাকলে পিএচডি করাই যথেষ্ট, এর বেশি কিছু করার দরকার পড়ে না। পড়ে না যদি না তিনি জামাল নজরুল ইসলামের মতো কেউ না হন। ১৯৮২ সালে অর্জন করেন ডিএসসি বা ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি, যেই ডিগ্রি সারা পৃথিবীতেই খুব কমসংখ্যক বিজ্ঞানী অর্জন করতে পেরেছেন। অবশ্য কৃতবিদ্য এই অধ্যাপকের একাডেমিক অঙ্গনে সাফল্যের ব্যাপারটা ধরা পরেছিল অনেক আগেই। মর্নিং শোজ দ্য ডে। সেই যে, ১৯৫৭ সালে কলকাতা থেকে অনার্স শেষ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজে গণিতশাস্ত্রে ট্রাইপস করতে গিয়েছিলেন। তিন বছরের কোর্স, উনি সেটা দুই বছরেই উনি শেষ করে ফেলেন। ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকার, যার নাম ফ্রেডরিক হয়েলের সঙ্গে উচ্চারিত হয় ‘হয়েল-নারলিকার তত্ত্ব’-এর কারণে, তিনি সেখানে নজরুল ইসলামের সহপাঠী ছিলেন। পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে তার বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, স্টিফেন হকিং, আব্দুস সালাম এবং রিচার্ড ফাইনমেন এর মতো বিজ্ঞানীরা। ফাইনমেন তাকে তার নিজের বাড়িতে দাওয়াত করেও খাইয়েছিলেন, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে উপহার দিয়েছিলেন একটা মেক্সিকান নকশিকাঁথাও।
অবশ্য কার সাথে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল আর না ছিল সেটা তাকে পরিচিত করেছে ভাবলে ভুল হবে। তিনি পরিচিত ছিলেন নিজের যোগ্যতাবলেই। পিএইচডি শেষ করে তিনি দুবছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড-এ কাজ করেন। মাঝে কাজ করেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্বখ্যাত ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবেও। ১৯৭৮ সালে লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন।
সেভাবেই থাকতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ১৯৮৪ সালে তিনি একটা বড় সিদ্ধান্ত নিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তগুলোর একটি। বিলেত-আমেরিকার লক্ষ টাকা বেতনের লোভনীয় চাকরি, গবেষণার অফুরন্ত সুযোগ, আর নিশ্চিত নিপাট জীবন সব ছেড়ে ছুড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিধ্যালয়ে তিন হাজার টাকার প্রফেসর পদে এসে যোগ দিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথম দিকে এমনকি এই তিনহাজার টাকা দিতেও গড়িমসি করেছিল। তারা বেতন সাব্যস্ত করেছিল আটশ টাকা। কিন্তু তারপরেও পাশ্চাত্য চাকচিক্য আর ডলার-পাউন্ডের সব মোহ হেলায় সরিয়ে দিয়ে অধ্যাপক নজরুল বিলেতের বাড়ি ঘর জায়গা জমি বেচে চলে আসলেন বাংলাদেশে। দেশটাকে বড়ই ভালোবাসতেন তিনি। তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এটার ভিন্নতা ঘটেনি কখনোই। আরেকটা দিক হলো, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না। ” তার দেশপ্রেমের নিদর্শন ১৯৭১ সালেও তিনি দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নির্বিচারে হত্যা খুন ধর্ষণে মত্ত হয়েছিল, তখন পাক-বাহিনীর এই আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠিও লিখেছিলেন।
দেশে ফিরে বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। শুধু বিজ্ঞানেই তাঁর অবদান ছিল না, তিনি কাজ করেছেন দারিদ্র দূরীকরণে, শিল্প ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করেছেন। তিনি মনে করতেন, আমাদের দেশটা যেহেতু কৃষিনির্ভর, তাই আমাদের শিল্পনীতি হওয়া চাই ‘কৃষিভিত্তিক, শ্রমঘন, কুটিরশিল্প-প্রধান’ এবং ‘প্রধানত দেশজ কাঁচামাল-নির্ভর’। তিনি বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ-এর ক্ষতিকারক প্রেসক্রিপশন বাদ দিয়ে নিজেদের প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটা সুষ্ঠু শিল্পনীতির প্রতি সবসময় গুরুত্ব দিতেন। পাশ্চাত্য সাহায্যের ব্যাপারে তার একটি বিখ্যাত উক্তি আছে –“তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালোমন্দ আমাদেরকেই ভাবতে দাও। আমি মনে করি, এটাই সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয়। ”
যারা অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের কাজ এবং চিন্তাভাবনা আরো বিস্তৃতভাবে জানতে চান তারা আলম খোরশেদ ও এহসানুল কবিরের নেওয়া বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম-এর সাক্ষাৎকারটি গুগলে সার্চ করে দেখে নিতে পারেন।
আইনস্টাইন যেমন বেহালা বাজাতেন, সত্যেন বোস যেমন এস্রাজ, ঠিক তেমনি জামাল নজরুল ইসলাম পছন্দ করতেন পিয়ানো বাজানো (এ ব্যাপারটা আমি হাল্কাভাবে শুনেছিলাম, তবে বিস্তৃতভাবে জানলাম তার ছাত্র প্রিয়ম মজুমদারের একটি ফেসবুক নোট থেকে)। তিনি ছিলেন গজল এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের বড় ভক্ত, পিয়ানোতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তুলতে তিনি পছন্দ করতেন। বাড়িতে বন্ধুর ছোট মেয়েটিকে প্রতি শুক্রবার ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙ্গামাটির পথ’ পিয়ানোতে বাজিয়ে শোনাতেন।
আর ভালোবাসতেন স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামকে! তার স্ত্রীও ছিলেন ডক্টরেট। একটা কনফারেন্সে তাদের দেখা, প্রেম এবং পরিণয়। শোনা যায়, ৫৩ বছরের দাম্পত্য জীবনে জামাল নজরুল তাঁর স্ত্রীকে ছাড়া কোথাও যেতেন না। কোনো অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে চলার সময় সবসময় স্ত্রীর হাত ধরে রাখতেন।
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ১৬ মার্চ। এই নিভৃতচারী কর্মমুখর ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ড. অভিজিৎ রায়: আমেরিকা প্রবাসী গবেষক, ব্লগার এবং মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। ‘ভালবাসা কারে কয়’ (শুদ্ধস্বর, ২০১২) সহ সাতটি আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শন ভিত্তিক বইয়ের লেখক।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৩
আরআর