অগ্নিঝরা মার্চ। একাত্তরের এই দিনগুলিতে মুক্তির শপথে বলীয়ান বীর বাঙালি।
আজও মার্চ সময় ২০১৩ । এদেশের তরণ প্রজন্ম রাজপথে সোচ্চার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের জন্য। তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলন স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশের প্রতিটি মানুষের আন্দোলন। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি শহরে, গ্রামে, পাড়া-মহল্লায়। একাত্তরের সেই আন্দোলন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের জন্য, একটি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার জন্য আর আজকের আন্দোলন স্বাধীন দেশের মানচিত্রকে আপদমুক্ত রাখার জন্য, এদেশের পতাকার সম্মান রক্ষার জন্য।
বাঙালি জাতির রয়েছে অনেক গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস। ইংরেজমুক্ত, পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত বাংলাদেশ এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসেরই অংশ। তারপরও থেমে নেই এদেশের মুক্তিকামী জনগণের সংগ্রাম। যতদিন এদেশের মানুষের প্রকৃত মুক্তি অর্জন না হবে ততদিন সেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম চলতেই থাকবে। আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ইতিহাসে অসংখ্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ছাড়াও রয়েছে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। এছাড়া রয়েছে প্রতিটি সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অব্যাহত সংগ্রাম। কিন্তু এতসব সংগ্রামের প্রকৃত ফসল এখনো পায়নি এদেশের জনগণ।
আজ আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার চেতনাকেও হারাতে বসেছি। সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজ তথা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি, গোষ্ঠী স্বার্থে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ম্লান করে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জনকে। দেশকে স্বাধীনতার চেতনায় গড়ে তোলার জন্য জাতি পাচ্ছে না কোন সঠিক নির্দেশনা। এক গভীর সংকটে আজ আমার দেশ। হয় মুক্তি নয় ধ্বংস। যে সংকটে এখন দেশ ক্ষমতার পরিবর্তনেও তার সমাধান আসবে বলে মনে করে না দেশের সাধারণ মানুষ । দেশের স্বার্থে প্রয়োজন এখন স্বাধীনতার পক্ষের গণতন্ত্রমনা রাজনীতিকদের ঐক্য।
এই সংকট নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে প্রকৃত রাজনীতিবিদদেরই। অসংখ্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনীতিবিদরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তার মূল্যও অপরিসীম। আমাদের স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক অসফলতার আরেকটি কারণ হলো জাতীয় রাজনীতিকে অরাজনীতিকদের হাতে তুলে দেওয়া। ৭৫ পরবর্তী সময়ে এদেশে রাজনৈতিক চর্চাকে রুদ্ধ করে দিয়ে অরাজনৈতিক সুবিধাভোগী পেশাজীবীদের রাজনীতিতে টেনে এনে রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে দেওয়ার পরিণতি এখন ভোগ করছে দেশ । এসব অরাজনীতিকদের কালো টাকা ও পেশী শক্তিনির্ভর রাজনীতি কলুষিত করেছে এদেশের গৌরবময় রাজনৈতিক ইতিহাসকে। এদের অপরিপক্ক রাজনীতি ও ব্যক্তি পূজা তৈরি করেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি, জন্ম দিয়েছে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্রের। সুযোগসন্ধানী এসব আমলা, ব্যবসায়ী, সেনা কর্মকর্তাদের হঠাৎ করে রাজনীতিতে আবির্ভাব জনভিত্তিসম্পন্ন সত্যিকার রাজনীতিবিদদের করেছে উপেক্ষিত। যে ছাত্র রাজনীতি মানুষকে পথ দেখিয়েছে বায়ান্ন, উনসত্তর, একাত্তর ও নব্বইয়ে সেই ছাত্র রাজনীতি তার মর্যাদা হারিয়ে চলছে বিপরীত পথে। বর্তমান ছাত্র রাজনীতি কালো টাকা ও পেশী শক্তিনির্ভর জাতীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস ও আতংকের আরেকনাম হয়ে উঠেছে। নেতৃত্ব লাভের জন্য ছাত্রদের মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জনের পরিবর্তে তারা অস্ত্রকে বেছে নিয়েছে আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে। ফলে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে মেধাসম্পন্ন ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না । বর্তমান ছাত্র নেতৃত্বের অনেকেরই যোগ্যতা ও নৈতিকতা নিয়ে সাধারন মানুষের রয়েছে সংশয়।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনরত দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির আভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা বা দলের লিখিত গঠণতন্ত্রের অনুসরণ করা হয় না তাদের দল পরিচালনায়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি সুস্থ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই উত্থান ঘটে রাজনৈতিক নেতৃত্বের। কিন্তু আমাদের এই প্রক্রিয়াটিই বন্ধ। গণভিত্তির পরিবর্তে সন্ত্রাস, কালো টাকা আর দলের প্রতি আর্থিক অনুদানের মাপকাঠিতে উপর থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছে নেতারা । ফলে রাজনীতি তথা মহান সংসদেও উল্ল্যেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রভাব। স্বাধীনতা পরবর্তী এদেশের রাজনীতিকদের অনেক ব্যর্থতা আছে অবশই। তারপরেও এদেশের গণতন্ত্রকে রক্ষাও করেছে এদেশের রাজনীতিকরা নতুবা আজও হয়তো এদেশের মানুষ তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের মতো স্বৈরশাসনের জাতাকলে পিষ্ট হতো।
এদেশের মানুষের চাহিদা অতি সামান্য। শুধু স্বাধীনতার চেতনায় একটি গণতান্ত্রিক শাষন ব্যবস্থা, একটু সুশাসন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে কার্যকর করে স্থানীয় গণপ্রতিনিধির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হলে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব তৈরির একটা প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্ষেত্র তৈরি হয়। একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেতৃত্ব তৈরি হলে দলের নীতিনির্ধারণে অধিকতর গ্র্রহণযোগ্য মেধাবী, দক্ষ ও পরীক্ষিত নেতাদের আসার পথ সুগম হয়। সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা, একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা সৃষ্টির উদ্যোগে আমাদের প্রকৃত রাজনীতিবিদরা যারা জাতির বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংকট উত্তরণের সংগ্রামের পরীক্ষায় পরীক্ষিত তাদের তো ভয় থাকতে পারে না। আজ জাতির এই সংকটময় পরিস্থিতিতে তরুণ প্রজন্মের মতো স্বাধীনতার পক্ষের সকল রাজনীতিকের ঐক্যের একান্ত প্রয়োজন। দলীয় সংকীর্ণতা ও প্রতিহিংসা থেকে বেরিয়ে দেশের প্রয়োজনে দেশপ্রেমিক প্রকৃত রাজনীতিবিদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে একাত্তরের মার্চে একটি মানুষের তর্জনী উত্তোলন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পরিণত করেছিল এক জাতিতে। তিনি ছিলেন না তখন কোন দলের নেতা তিনি হয়ে উঠেছিলেন এদেশের কোটি কোটি মানুষের নেতা। জাতির প্রয়োজনে এদেশের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সংগ্রামে অকুতোভয় লড়াই করেছে। রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে অধিকার। সেইসব লড়াইয়ের আবেগ ও সংকল্প নিয়ে আজ আবার জেগে উঠেছে এদেশের মুক্তিকামী সাধারণ জনতা, সোচ্চার হয়েছে অপরাজনীমুক্ত একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য। শুধু প্রয়োজন এখন সঠিক নেতৃত্ব। কে হবে জাতির এই সংকট উত্তরণের কাণ্ডারি? আব্রাহাম লিংকনের ভাষায় আমাদের বলতে হয়, “We like to see a man proud of the place in which he lives. We like to see a man live so that his place will be proud of him”.
লেখক: পেশাজীবী, পুঁজিবাজারে কর্মরত
বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৩