এই তো কিছুদিন আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছিল সাপের খেলা। বিরোধীনেত্রী খালেদা জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে আওয়ামী লীগ নিয়ে এনালাইসিস করে চমত্কার একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করেন।
বিরোধীনেত্রীর এই “সাপতত্ত্ব” নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার দলের বিশিষ্ট কয়েকজন ‘মজলুম নেতা’ তখন যেখানেই যা বলেন, খালেদার “সাপতত্ত্ব” ছাড়া কিছুই বলেন না।
“সাপতত্ত্ব” প্রকাশিত হবার পরদিন সোহরাওয়ার্দীউদ্যানের বিজয়মঞ্চে বাংলাদেশে ছাত্রলীগ আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন বিরোধীনেত্রীই নাকি সাপ নিয়ে খেলছেন। শুধু খেলছেন যে তা নয়, তিনি নাকি সাপের ঝাঁপি মাথায় নিয়ে ঘুরছেন।
ওনারা যে এত এত কাজের ভিড়েও খেলাধুলা করার সময় পান, তা জেনে আমরা দর্শক-জনতা সত্যি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম!!
এরপর স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, বিরোধীনেত্রীর পরিচয়। নানক ব্যাপক গবেষণা করে জেনেছেন যে, খালেদা জিয়াই নাকি বিষধর সাপ। আর তার দল আওয়ামী লীগ জনগণকে সাথে নিয়ে এই বিষধর সাপকে মোকাবিলা করছে।
আরও চমকপ্রদ তথ্য জানতে পারি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিমের কাছ থেকে। তিনি বলেন যে, “খালেদা শুধু বিষধর সাপ না, একটি কালনাগিনীও”।
সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী এসময় খালেদা জিয়াকে ক্রেডিট দিয়ে বলেন যে, খালেদা জিয়া সাপ খুব ভালো চেনেন। অথচ সাজেদা চৌধুরী দাবি করেন খালেদা জিয়া নয় আওয়ামী লীগ নাকি সাপ থেকে জাতিকে রক্ষা করছে। তার মানে দাঁড়ালো যে, আওয়ামী লীগও ভালো সাপ চেনে!!
এদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন যে, খালেদা জিয়া মানুষকে বিশ্বাস না করে সাপের সঙ্গে বসবাস করছেন।
সাপ নিয়ে এত এত গবেষণা ও পোস্ট-গবেষণাতে বেচারা সাপের যে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়েছিল, তা আমরা জনগণ শুধু দর্শক হয়ে উপভোগ করেই গেলাম।
আসলে কালজয়ী এই “সাপতত্ত্বের” আইডিয়া মূলত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত নভেম্বরে তিনি প্রথম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, খালেদা জিয়া নাকি সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ার খেলা খেলছেন। কিন্তু বিরোধীনেত্রী প্রধানমন্ত্রীর সাপ নিয়ে এই চমকপ্রদ আইডিয়াটি থেকে যে এমন একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষণা করবেন, তা হয়ত আওয়ামী লীগ ধারণাও করতে পারে নি।
এরপর বেশ কিছুদিন বাদে আমরা জনগণ আবার নতুন এক তত্ত্বের সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। এবার হলো “রক্ততত্ত্ব”। এবারের আলোচিত তত্ত্বের আবিষ্কারক যথারীতি বিরোধীদলের নেত্রী। কারণ তিনি প্রথম আবিষ্কার করেন যে, ‘এই সরকার রক্তপিপাসু খুনি সরকার’। “সাপতত্ত্বের” ন্যায় বিরোধীদল নেত্রীর এই “রক্ততত্ত্ব” যথারীতি আওয়ামিলেগের কাছে সুপার হিট।
“রক্ততত্ত্ব” প্রকাশিত হবার ঠিক একদিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৩তম জন্মদিন উপলক্ষে আবার সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুসারীরা সমস্ত কাজ ফেলে এই তত্ত্ব নিয়ে পোস্ট-গবেষণায় ব্যস্ত। কে রক্তপিপাসু, কতটা রক্ত খেয়েছে, কার কার রক্ত খেয়েছে, কোথায় খেয়েছে, আর কত রক্ত খাবে এই নিয়ে চলছে আলোচনা।
শেখ হাসিনা বিরোধীনেত্রী খালেদা জিয়াকেই পাল্টা রক্তপিপাসু বলে অভিহিত করেন। এমনকি আর কত রক্ত খালেদা জিয়া পান করতে চান সেটাও তিনি জিগ্যেস করেছিলেন। এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া রক্তপিপাসু ডাইনি হয়ে গেছেন।
তো সাপ অভিধা থেকে এখন দুজন নেত্রী একজন অন্যজনকে ‘রক্তপিপাসু’ বলে চলেছেন। একের পর এক হাস্যকর নির্লজ্জ তত্ত্ব আবিষ্কার করে দুজন দুজনের চরিত্র জনগনের কাছে উন্মোচন করে দেয়া ছাড়া আর কি কিছু কি করছেন?
যাদের টাকায় তারা বক্তৃতা দেয়ার জন্য শক্তি সঞ্চয় করেন, যাদের ভালো-মন্দের চিন্তায় নাকি তাদের ক্ষমতা নামক মসনদটি যেভাবেই হোক চাই-ই চাই, সেই "জনগণের" কথা আদৌ কি তারা চিন্তা করেন? দেশের প্রতি যদি প্রকৃত ভালবাসাই থাকত তবে এভাবে ক্ষমতা নামক মসনদে বসার জন্য তারা মরিয়া হবেন কেন? ক্ষমতায় থাকার স্বাদ তো দু দলেই নিয়েছিল, একটু ধৈর্য ধরলে দু দলেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত যুগের পর যুগ ভাগাভাগি করে এই ক্ষমতার স্বাদ নেবে। তাহলে কেন মাঝখান থেকে জনগনের সাথে এই উন্মত্ততা?
আমাদের কষ্টে অর্জিত টাকায় রাজনৈতিক দলের প্রায় সবাই দামি গাড়িতে চড়েন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকেন, সবার ছেলে মেয়েরা দেশের বাইরে পড়াশুনা করেন। জনগণের জন্য যদি এত দরদ তবে নিজেদের ছেলেমেয়ে নাতিপুতিদের এনে হরতাল সফল বা ব্যর্থ করতে পিকেটিং করতে বলুন। নিজেরা পেট্রল বোমা, ককটেল নিয়ে মাঠে নামুন। নিজেদের দামি গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে একে অপরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। এইসব হাস্যকর তত্ত্ব আবিষ্কারে সময় নষ্ট না করে কিভাবে নিজেদের আখের ভালোভাবে গোছানো যায় সেই চিন্তা করুন।
আমরা জনগণ হরতাল সফল-ব্যর্থ কোনোটাই চাই না। আসলে আমরা এখন আর দু দলের কারো কাছেই কিছু চাই না। আমাদেরকে পরিবার পরিজন নিয়ে জীর্ণ কাঁথায় শুয়ে অন্তত শান্তির ঘুম ঘুমাতে দিন।
©জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্লগার;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর