শাওন আহমেদ থাকে ঢাকার শনির আখড়ায়। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে।
কোচিং থেকে বাসায় ফেরার সময় যাত্রাবাড়ীতে পিকেটারদের ধাওয়া খেয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। আমার সামনেই বাস পোড়ানো হয়েছিল একটা। দেখেছি, কিভাবে মানুষ প্রাণের মায়ায় লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছে। সেদিন বাসায় ফিরে লেখাপড়া করতে মন বসছিল না অনেকক্ষণ। আমার পরীক্ষা শুরু ১ এপ্রিল থেকে। আতঙ্কে আছি, আবার ধাওয়া খেতে হয় কি না, কিংবা জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে পড়তে হয় কি না!
রাজনীতিবিদরা আমাদের অভিভাবক, দয়া করে আমাদের ক্ষতি করবেন না। আমরা আপনাদের শত্রু নই। রাজনীতির কারণে সরকার আপনাদের প্রতিপক্ষ, সেটা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করুন। আমাদের ক্ষতি করে কিছু করতে যাবেন না। আপনারা আমাদের সেবা করার জন্য যদি রাজনীতি করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের হত্যা করে, জীবন নষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। আমি মনে করি, সবই আপনারা আমাদের চেয়ে বেশি জানেন। দয়া করে সে জানাটাই কাজে লাগান। অন্তত আমাদের পরীক্ষা চলাকালে হরতাল, ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো কোনো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দেবেন না। `
শাওনের মতো এই আরজি দেশের সাত হাজার ৮০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এইচএসসি পরিক্ষার্থীদের। হরতালের কারণে পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা যেমন উৎকণ্ঠা-উদ্বেগে, তেমন উৎকণ্ঠা-উদ্বেগে অভিভাবকরা। যে পরিবারের একটি ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষা দেয়, তাকে নিয়ে পুরো পরিবারটির মধ্যে এমনিতেই তৈরি হয় এক ধরনের অস্থিরতা। তার ওপর হরতাল, অনিশ্চয়তা। ১০ লাখ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে তাদের অভিভাবক, শিক্ষক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলিয়ে কোটিখানেক মানুষ চিন্তিত, অস্থির, আতঙ্কিত। আমার ছেলে বা মেয়েটি ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারবে তো! পরীক্ষা দিয়ে ঠিকমতো বাড়ি ফিরে আসতে পারবে তো!
একদিকে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা প্রস্তুতির টেনশন, রেজাল্ট ভালোমন্দের টেনশন, অন্যদিকে হরতাল আতঙ্ক। সমাজের কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ওপর এ কোন নির্যাতন শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো? হরতালে স্কুল খোলা রাখার অপরাধে এক প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছনা করা হয়েছে, ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীর ওপর হামলা হয়েছে। ক্লাসরুমে আতঙ্কিত, হামলার শিকার ছাত্রছাত্রীরা যে বেঞ্চে বসে পড়ার কথা, সেই বেঞ্চে শুয়ে আছে।
এ রকম দৃশ্য কি সহ্য করা যায়!
যারা হরতাল দিচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মসূচি দিচ্ছে, সেই সব দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের ছেলেমেয়েরাও তো অনেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে। সরকারি দলের যাঁরা আছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও তো ঘটছে একই ঘটনা। তাঁদের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের ছেলেমেয়েরাও পরীক্ষার্থী। তাঁরা কেউ কি বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না? কিভাবে সমঝোতার মধ্য দিয়ে সমাধান করা যায় এই রাজনৈতিক অত্যাচার, কেন বড় দলগুলো, বড় নেতারা, দেশের সুধীসমাজ আর বিবেকবান মানুষ দেশটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া অরাজকতা সামাল দিতে এগিয়ে আসছেন না? আমরা সাধারণ মানুষ, জনগণ আর কতকাল বলির পাঁঠার ভূমিকায় থাকব আর রাজনৈতিক দলগুলো থাকবে খৰহস্ত!
গত দুই মাসে ১৭১ জন মানুষ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। পুলিশ গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে, পুলিশকেও মেরেছে হরতালকারীরা। আহত হয়েছে বহু পুলিশ, বহু হরতালকারী। রাজশাহীতে সংঘর্ষকারীদের বোমার আঘাতে মকবুল হোসেন নামে পুলিশের এক উপপরিদর্শকের এক হাতের কবজি উড়ে গেছে, অন্য হাতের তিনটি আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর মায়ের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। দেশের মানুষের মুখে এখন শুধু একটাই কথা- এ অবস্থা থেকে কবে পরিত্রাণ পাব আমরা? কবে একটু শান্তি-স্বস্তি ফিরে আসবে দেশে! এ অবস্থায় দেশ চলতে পারে?
কালের কণ্ঠ হেডিং করেছে `হরতালের সূর্য অস্ত যায় না বাংলাদেশে`! তার মানে চির হরতালের দেশ হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশ! এ জন্য আমরা ভাষা আন্দোলন করেছি, গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি?
হায়, আমাদের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে! যে দুই নেত্রী পারেন এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে, তাঁরা যে যাঁর অবস্থানে অনড় হয়ে আছেন। এদিকে হরতালের সূর্য অস্ত যাচ্ছে না, সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পোড়ানো হচ্ছে, মন্দিরে আগুন, প্রতিমা ভাঙচুর, পুলিশ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কাজ, হরতালকারীরা বাস্তবায়ন করছে দলের কর্মসূচি, জনগণ জিম্মি হয়ে আছে। অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ছোট, মাঝারি, বড়- সব ব্যবসায়ী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চলছে হাহাকার। দেশের একজন মানুষও ভালো নেই।
এ কেমন রাজনীতি? দেশ ধ্বংস করে কার স্বার্থে এই রাজনীতি! জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, ছাত্রছাত্রীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অর্থনীতি পঙ্গু, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা আর বাধা, একি কোনো রাজনীতি হতে পারে? আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কাদের জন্য রাজনীতি করে? গুটিকয় নেতা-নেত্রীর জন্য, নাকি জনগণের জন্য?
এই প্রশ্ন কাকে করব? কার কাছে উত্তর পাব?
নিউ খানপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে কালের কণ্ঠ মতামত পাতায় দেলোয়ার হোসেন দেলু লিখেছেন, `সরকারের উচিত নমনীয় হওয়া। ` তাঁর বক্তব্য, `সাধারণ মানুষকে এখন বলতে শোনা যায়, সরকার যা করছে তা আত্মহত্যাচেষ্টারই নামান্তর। দেশ এখন এক বিশৃঙ্খল অরাজক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের উচিত ছিল এই অরাজক পরিস্থিতির ইতি টানার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এই লক্ষ্যে বিরোধী দলের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনাটাও ছিল জরুরি। কিন্তু তা হয়নি, সেই দূরত্ব বরং বেড়েই চলেছে। এতে শেষরক্ষা হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
আমরা দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের প্রতি আরেকবার আবেদন জানাচ্ছি, তারা যেন দমন-পীড়নের পথ পরিহার করে কিভাবে সংকট কাটানো যায় সে লক্ষ্যেই নীতিনির্ধারণ করে। এখন তা না করলে সামনে বড় ধরনের অরাজকতা মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে। আর মনোভাবের পরিবর্তন না হলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় যখন একের পর এক ঘোষিত হবে এবং বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যখন আরো প্রবল হয়ে উঠবে, সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে চরম স্বৈরাচারী হওয়া ছাড়া সরকারের উপায় থাকবে না।
সে অবস্থা দেশকে যে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলবে, তা ভাবলে আমাদের গা শিউরে ওঠে। আমরা সবাই এ থেকে শিগগিরই পরিত্রাণ চাই এবং কোমলমতি শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা যাতে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে পারে, এর জন্য দুই নেত্রীর সুবিবেচনা কামনা করি। `
আবার এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কথায় ফিরি। মো. ফেরদৌস ওয়াহিদ, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম থেকে একটি পত্রিকায় টেলিফোনে মন্তব্য করেছে ১ এপ্রিল। সে এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ফেরদৌস বলেছে, `হরতাল দিলে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে। আমরা ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারব না। আমাদের অনুরোধ, আমরা যেন হরতালের বলি না হই। `
আঠারো-উনিশ বছরের এক পরীক্ষার্থীর এই আকুতি কি রাজনৈতিক নেতাদের মন গলাবে?
আমরা জানি, সামনে আরো হরতাল আসছে। কিন্তু সেই হরতাল যেন কিছুতেই এইচএসসি পরীক্ষার দিন দেওয়া না হয়। বিরোধী দলগুলোর কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ, এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কথা ভাবুন, আমাদের সন্তানদের দয়া করুন। তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা না বাড়িয়ে শান্তি-স্বস্তিতে পরীক্ষা দিতে দিন। আলোকিত মানুষ হিসেবে তাদের তৈরি হতে দিন।
সৌজন্য কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৩