লন্ডন থেকে: মহামান্য রাষ্ট্রপতি বাঙালির জাতীয় জীবনে এই মূহূর্তে আপনার অভিভাবকত্ব যখন আরও বেশি প্রয়োজন ছিল, ঠিক তখনই আপনি চলে গেলেন।
আপনাদের দিয়ে যাওয়া দেশটি যখন স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শকুনের কড়াল থাবায় আবারও ক্ষতবিক্ষত ঠিক তখন আপনার বটবৃক্ষের মতো ছায়া জাতির বড় বেশি প্রয়োজন ছিল, অথচ আপনি সেই ছায়া গুটিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির থাবা থেকে আমাদের জাতীয় পতাকা আমরা রক্ষা করতে পারিনি, রক্ষা করতে পারিনি ভাষা আন্দোলনের ফসল শহীদ মিনার? এটিই আপনার অভিমান!
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সন্তানের উপর অভিমান করে কেউ কি চিরতরে চলে যায়? দীর্ঘ সুরঙ্গের পর আমরাতো মাত্র আলোর দিকে ধাবিত হচ্ছি। আরও কিছু সময় কি আপনি আমাদের দিতে পারতেন না?
আপনার যে যৌবন ভাষা আন্দোলন করে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষা করেছিল, সেই সাহসী যৌবন নিয়েই তো আজ শাহবাগ কাপাচ্ছে আমাদের ছেলেরা, যে কাঁপন আজ দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও তৈরি করেছে আলোড়ন। সেই সাহসী যৌবনের উপর আস্থা রেখেই আপনার আরও কিছুদিন অন্তত আমাদের অভিভাবকত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না দিয়েই আপনি চলে গেলেন।
মাননীয় রাষ্ট্রপতি, সেই তরুণ বয়সে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার মাধ্যমে জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে যে যাত্রা আপনি শুরু করেছিলেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করার আগ পরযন্ত আপনি সেই ব্রত নিয়েই কাজ করে গেছেন। আপনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
দেশ, জাতি ও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আপনার ত্যাগ আপন গৌরবে উদ্ভাসিত। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আজীবন লড়াকু সৈনিক সহধর্মিনী আইভি রহমানকে আপনি হারিয়েছিলেন ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির নিষ্ঠুর গ্রেনেডের আঘাতে। সেই গ্রেনেড এখনও যে বিস্ফোরিত হচ্ছে আপনার স্বাধীন বাংলার পথে-প্রান্তরে, ধ্বংস করছে শত শত মানুষের জীবন। এমনি এক ক্রান্তিকালে আপনার চলে যাওয়া কি সঠিক সিদ্ধান্ত হলো মহামান্য রাষ্ট্রপতি?
হে আলোকিত মানুষ, প্রিয় সহধর্মিনী আইভি রহমানের মৃত্যু আপনার ব্যক্তিগত জীবনে ঝড় বইয়ে দিলেও দেশ ও জনগনের কাছ থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। অথচ স্বাধীনতা বিরোধী মৌলবাদী দানবের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত, বাংলাদেশের এই মূহূর্তে যখন প্রয়োজন আপনার বটবৃক্ষতুল্য ছায়া, ঠিক তখন আপনি বাঙালির কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন চোখের নিমিষে। জাতিকে করে গেলেন অভিভাবকহীন । এটি আমাদের প্রতি অবিচার নয় কি?
৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপনার সর্বোচ্চ ত্যাগের ইতিহাস যখন নতুন প্রজন্মকে যুদ্ধাপরাধীবিরোধী আন্দোলনে সাহস যোগাচ্ছে ঠিক তখনই আপনি হারিয়ে গেলেন।
হে আপোষহীন জননেতা, আদর্শিক অঙ্গীকারের প্রতি আপনার দৃঢ়তা জীবিতাবস্থায়ই আপনাকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিল। স্ত্রীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরও সব ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে দৃঢ়তা নিয়ে আপনি দেশবাসীকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা জাতি হিসেবে আমাদের সাহসী করে তুলেছিল। আপনার কাছে আমরা ঋণী। রাজনীতিতে আপনি ছিলেন একজন সফল ব্যক্তি। সেই তরুণ বয়সে মাঠ পরযায় থেকে রাজনীতি শুরু করে জীবনের শেষ পরযায়ে আপনি ছিলেন জাতীর অভিভাবক, দেশের রাষ্ট্রপতি। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থান কয়জন রাজনীতিকের ভাগ্যে জুটে। আপনার ত্যাগ-তিতিক্ষা আর যোগ্যতাই আপনাকে এই পরযায়ে নিয়ে এসেছিলো, স্যাল্যুট আপনাকে।
হে ত্রি-কালদর্শী রাজনীতিক, বড় সৌভাগ্যবান ছিলেন আপনি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন একজন কর্মী, বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ছিলেন একজন তরুণ নেতা, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন একজন শীর্ষ সংগঠক। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা হয়ে এক সঙ্গে রাজপথ কাঁপিয়েছেন বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে।
ইতিহাসের ত্রিকালদর্শী সাক্ষী হয়ে জীবনের শেষ প্রান্তে মৃত্যুর আগ পরযন্ত আপনি ছিলেন আমাদের রাষ্ট্রপিতা। আপনার মত গুণী ব্যক্তির অভিভাবকত্বে আমরা ছিলাম ধণ্য। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমাদের।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, জনসান্নিধ্যের বড় কাঙাল ছিলেন আপনি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর প্রটোকলের কারণে আপনি হয়ে পড়েছিলেন জনসান্নিধ্যহীন। লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে আপনি জনসান্নিধ্যের আকুতির কথা প্রকাশ করেছিলেন আমাদের কাছে। আপনাকে কিভাবে আমি জানাবো যে, আপনার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হবার পর দেশ-বিদেশের মানুষের মধ্যে যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তাতে প্রমাণ হয়েছে আপনি শেষ জীবনেও জনসান্নিধ্যহীন ছিলেন না। ব্যক্তি জিল্লুর রহমানের শুধু দেহটিই ছিল বঙ্গভবনের নিরাপত্তার জালে আবদ্ধ।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, পরিণত বয়সে আপনি চলে গেছেন, কিন্তু এরপরও মনে হচ্ছে জাতির প্রয়োজনে আপনার উপস্থিতি প্রয়োজন ছিল আরও দীর্ঘকাল। মৃত্যু এমন একটি বিষয়, যা মেনে নিতে হয়। আমরাও হয়তো নিচ্ছি। কিন্তু আপনি অভিভাবকের ছায়া হয়ে আজীবন পাশে থাকবেন, পাশে আছেন বঙালির।
আপনার সংগ্রামী জীবন যুদ্ধাপরাধী বিরোধী চলমান আন্দোলনসহ ভবিষ্যত সব গণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবে। বিদায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি, শেষ বিদায়ের স্যালুট আপনাকে।
লেখক: বাংলা নিউজের লন্ডন করেসপন্ডেন্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫২ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৩