ব্লগারদের ওপর এবং সর্বোপরি মুক্তচিন্তার ওপর আগ্রাসন থামছে না। ধর্মান্ধদের শারীরিক আক্রমণের পাশাপাশি এখন শুরু হয়েছে মানসিক আক্রমণ।
আসিফ মহিউদ্দীন ব্লগ লেখেন। মূলতঃ সামহোয়্যারইন নামের জনপ্রিয় ব্লগ সাইটে। তার অন্য কোন পরিচয় ছিল না। ব্লগে লেখার মাধ্যমেই পরিচিত হয়েছেন তিনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে ব্লগ লিখে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। করা হয়েছে নানা ধরনের হেনস্তা।
এ অবস্থা যেতে না যেতেই হয়েছেন মৌলবাদীদের আক্রোশের শিকার। অফিস থেকে ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে তাকে, ঠিক যেভাবে কুপিয়ে হত্যা হয়েছে শাহবাগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ব্লগার ‘থাবা বাবা’ ওরফে রাজীব হায়দারকে। সেরকমভাবেই মারা যেতে পারতেন আসিফও। সৌভাগ্যক্রমে তা হয়নি।
আসিফের লেখনী বন্ধ করা যায় নি তখন। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েই আবার লেখালেখিতে ফেরত আসতে পেরেছিলেন তিনি। যে কাজটি মৌলবাদীরা করতে পারেনি, তা করতে চাইছে যেনো সরকার। তার ব্লগ, যা ছিল তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর, যে ব্লগের জন্য তিনি ডয়েচে ভেল প্রদত্ত অন্যতম সেরা ব্লগারের পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন, হয়েছিলেন সামহোয়্যার ইন ব্লগ থেকে ২০১১ সালের সেরা ব্লগার নির্বাচিত, সেই এতদিনকার তিলে তিলে গড়ে তোলা আসিফের কষ্টসাধ্য ব্লগ একাউন্ট সামহোয়্যারইন কর্তৃপক্ষ মুছে দিয়েছেন। এমনি এমনি মুছে দেননি। মুছে দিয়েছেন সরকারি চাপে!
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) থেকে চাপ দিয়ে বন্ধ করার অভিযোগ আছে পেছনে। যে কাজটি মৌলবাদীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে করতে পারেননি, সেটা কি দ্রুত সমাধা করে। মুখে টেপ মেরে বাকরুদ্ধ করে দিতে চাইলেন একজন স্বাধীন ব্লগারের মুখের ভাষাকে, হাতে শিকল পরিয়ে কেড়ে নিতে চাইলেন তার লেখনীকে - কেবল ক্ষমতার কলকাঠি নেড়ে।
চাপ কেবল সামহোয়্যারইনেই আসেনি, এসেছে আরেকটি জনপ্রিয় ব্লগ সাইট ‘আমার ব্লগ’-এও। পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার ব্লগের কাছে ব্লগারদের তথ্য চেয়েছে বিটিআরসি’ শিরোনামের খবরে আমার ব্লগ ডটকম কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছেন যে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের সহকারী পরিচালক প্রেরিত এক ই-মেইলে আমার ব্লগের অন্ততঃ ছয়জন ব্লগারদের লগইন বৃত্তান্ত, আইপি ও ই-মেইল ঠিকানা চাওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের সব লেখা ২১ মার্চের মধ্যে মুছে ফেলতে বলা হয়েছে।
এ ধরনের ইমেইল পেয়ে সামহোয়্যারইনের কর্মকর্তারা কোন কৈফিয়ত না দিয়ে, চুপি চুপি আসিফের একাউন্ট মুছে দিলেও,একই কাজ করেনি আমার ব্লগ কর্তৃপক্ষ। তারা একটি নোট দিয়েছেন তাদের ব্লগে যেখানে স্পষ্ট করে বলেছেন –
‘আন্তর্জালে বাংলায় বাক স্বাধীনতা রক্ষায় শুরু থেকেই দায়বদ্ধ আমার ব্লগ। আর তা যে কোনো মূল্যে অক্ষুন্ন রাখতে আমার ব্লগ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো, আছে এবং থাকবে! সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমার ব্লগ বিটিআরসির নির্দেশ প্রত্যাখান করছে। আমার ব্লগ কোন ব্লগারের ব্লগ বাতিল করবে না- আন্তর্জাতিক প্রাইভেসি আইন অনুযায়ী কোন ব্লগারের আই পি এড্রেস, লোকেশন, ইমেইল, মোবাইল নম্বর এবং ব্যক্তিগত নাম প্রকাশ করবে না।
প্রিয় ব্লগার, এ ব্যাপারে আমরা দেশের একাধিক প্রথিতযশা আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং কোন আইনবলে বিটিআরসি কোনো ব্লগারের ব্যক্তিগত তথ্য এবং তাঁর লেখার আর্কাইভের কপি দাবি করেছেন ব্যাপারটি খতিয়ে দেখছি। জনপ্রশাসনের এখতিয়ার বহির্ভূত যেকোন হস্তক্ষেপকে আমরা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করব।
আমার ব্লগ.কম-এ লেখালেখির জন্য যদি কোনো ব্লগার সরকারি রোষাণলে পড়েন তাহলে আমার ব্লগ কর্তৃপক্ষ তাঁর সাধ্যমত সকল প্রকার সহায়তা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে। কোনো ব্লগারের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে হয়রানি করা হলে সেই সংক্ষুব্ধ ব্লগার যদি সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণসহ যেকোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে ইচ্ছুক হন, আমার ব্লগ.কম এর পক্ষে তাঁকে লিগ্যাল সাপোর্ট দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ‘
আমি ‘আমার ব্লগ’-এর এই সাহসী পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। এটা দরকার ছিল। দেশের চরম দুর্দিনে দরকার এই ঋজু মনোভাবের। কেন তারা ব্লগারদের নাম ধাম, লগইন বৃত্তান্ত, ঠিকানা খোঁজার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন? ভয়টা কোথায়? যেখানে লাগা দরকার সেটা তারা করতে পারছেন না।
ফেসবুকে এখনো বাঁশের কেল্লা আর নিউ বাঁশের কেল্লার মতো সাইট উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তাদের এই সাম্প্রদায়িক উস্কানির বলি হয়ে নির্যাতিত হয়েছেন শত শত সংখ্যালঘু পরিবার। ধর্ষিতা হয়েছেন, গুম খুন হয়েছেন। রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে, হয়েছে হাজার হাজার বৃক্ষ কর্তন। চাঁদে সাইদীর মিথ্যা ছবি প্রচার করে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষকে সম্মোহিত করার প্রচেষ্টা করেছে। তাদের সাইট বন্ধ হয়নি, বন্ধ করা যায়নি তাদের কর্মকাণ্ড।
আর বাঁশের কেল্লাই বা বলি কেন? বাঁশের কেল্লার চেয়েও উগ্র সাইট বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে যাচ্ছে। বন্ধ করতে পারেনি হিযবুত তাহরীরের মত উগ্রবাদী দলগুলোর প্রচারণাও।
এই যে হিযবুত তাহরীরের সাইডকিক - ‘আনসারউল্লাহ বাংলা টিম’ নামের উগ্রপন্থী গ্রুপ যাদের কয়েকজন সদস্য রাজীব হত্যায় জড়িত ছিল, তাদের সাইটে গেলে যে কেউ দেখবে, বাংলা ভাষায় কিভাবে বোমা বানানোর নির্দেশিকা দেওয়া আছে, আছে নানা ধরনের উষ্কানিমূলক বার্তা। ‘রান্নাঘরে বসেই কিভাবে বোমা বানানো যায়’ – এ ধরনের শিরোনামে নির্দেশিকা আছে; আছে নারীদের আত্মঘাতী হামলায় উদ্বুদ্ধ করার মতো পোস্ট –‘ইমানদার বোনেদের দায়িত্ব কর্তব্য` শিরোনামে।
রাজীবের হত্যাকারীদের ‘বীর’ হিসেবে উপাধি দেওয়া হয়েছে এগুলো সাইটে। ভিডিও ছাড়া হয়েছে - ‘চেরি পিকিং’ করে ধর্মগ্রন্থের রেফারেন্স কিংবা ধর্মপ্রচারকদের কর্মকাণ্ড দিয়েও রাজীব হত্যাকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন এই সব উগ্র ধর্মান্ধরা। অথচ মাননীয় সরকারের চোখে এগুলো পড়ছে না।
তারা খড়গ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রগতিশীল কিছু ব্লগারদের যারা কাউকে চাপাতি দিয়ে কোপাননি, কাউকে উস্কানি দেননি, আক্রমণ করেননি; বরং আক্রান্ত হয়েছেন, যারা কুসংস্কার, ধর্মীয় উগ্রতা আর ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।
যেখানে সাধারণ মানুষ ছাব্বিশে মার্চের মধ্যে জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ দল হিসেবে দেখতে চেয়েছিল, তাদের নিষিদ্ধ না করে নিষিদ্ধ করছেন ধর্মের প্রভাবমুক্ত প্রগতিশীল ব্লগারদের, যারা মূলতঃ জামায়াত শিবিরসহ সব মৌলবাদী দলগুলোর বিরুদ্ধেই সোচ্চার। ‘সত্যি সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ’!
আসিফ মহিউদ্দীনের এই ঘটনার পর ব্লগার এবং ‘মুসলিম জগতের জ্ঞানতাত্ত্বিক লড়াই’ নামের চমৎকার বইটির সুলেখক পারভেজ আলম কতকগুলো চমৎকার কথা বলেছেন, তার স্ট্যাটাসে । বলেছেন, ‘ব্লগিং কারো পেশা নয়। ব্লগ লিখে টাকা পাওয়া যায়না। ব্লগাররা এদেশের নানান ধর্ম, শ্রেণী ও পেশার মানুষ মাত্র। নিজেদের চিন্তা ভাবনা, আশা আকাঙ্ক্ষা, বিপ্লবের বাসনা তারা ব্লগে লিখে প্রকাশ করেন।
একজন ব্লগার নাস্তিকও হতে পারে, আস্তিকও হতে পারে। একজন ব্লগার দিনশেষে একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ছাত্র, শিক্ষক, বেকার, গৃহিণী অথবা ‘নেহায়েত ভাদাইম্মা’। তারপরেও সে যখন ব্লগিং করে, নানান সম্পর্ক ও ঐক্য নির্মাণ করে এবং একইসাথে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে চায় তখন সে আসলে গ্রামসি যাকে ‘অর্গানিক বুদ্ধিজীবী’ বলেছে সেই অর্গানিক বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাটাই পালন করে।
গ্রাসরুট বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে সে সিভিল সোসাইটির নিচ থেকে ধাক্কা দেয় উপরের দিকে। তাতে সিভিল সোসাইটি নতুন সম্ভাবনায় কাপে, পলিটিকাল সোসাইটি নড়েচড়ে বসে। একজন ব্লগারকে তাই দিনশেষে নানামুখী ক্ষমতার সাথে লড়াই করতে হবে, যদি সে ব্লগার হিসাবে বেঁচে থাকতে চায়’। কথাগুলো খুবই সত্যি।
আমি নিজে ব্লগ করে টাকা পয়সা পাই না, চাইও না। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তির ওপর আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিবেকের তাড়নাতেই কলম মানে কিবোর্ড ধরেছি। ধরেছি দেশের মঙ্গল চাই বলেই। ব্লগার রাজীবের হত্যার পর আমি বাংলানিউজে লিখেছিলাম, ‘কেন কেবল তারাই আক্রান্ত হচ্ছেন?’। সানিউর আক্রান্ত হবার পরে লিখেছিলাম, ‘সানিউরের ওপর আক্রমণ নিয়ে দু’কলম’। সেই এই ধারায় অর্থাৎ, বিবেকের তাড়নাতেই এই লেখাটিও লিখছি।
আসিফ মহিউদ্দীনের ব্লগ মুছে দিয়ে সামহোয়্যারইন কর্তৃপক্ষ এবং সরকার প্রমাণ করলো মুক্ত চিন্তা করার তো দূরে থাক, সহ্য করার মানসিকতাও এখনো তাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। হয়তো আসিফের কথাই ঠিক। ব্লগ সাইট মুছে দেবার পর যে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছে প্রথাভাঙা লেখক হুমায়ুন আজাদের অবিস্মরণীয় লাইনগুলো –
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চ`লে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ`লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল......
তবে আমি এতোটা নৈরাশ্যবাদী নই এখনো। আমি আগেই বুঝেছিলাম যে শাহবাগের এই আন্দোলন গুটিকয় রাজাকারের ফাঁসিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। সামগ্রিকভাবে দেশের কাঠামো বদলের আন্দোলন হয়ে উঠবে এটি। একাত্তরে যেমন হয়েছিল। প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে শুভবুদ্ধির এহেন সঙ্ঘাত ছিল অনিবার্য। এই সঙ্ঘাত আমার মতে ছিল প্রয়োজনীয়ও। এই সম্মুখ লড়াই থেকেই ঘটবে নতুন দেশের, নতুন স্বপ্নের বিনির্মাণ।
আমি প্রত্যাশা করি, লড়াই শেষে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ায় মত্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার বাহকেরা নিক্ষিপ্ত হবেন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে, যেমন হচ্ছেন আজ একাত্তরের রাজাকারেরা আর আলবদরেরা দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধে। এই বোধটুকু সরকারের যত তাড়াতাড়ি আসে ততই মঙ্গল। সুমনের গানের উল্লেখ করেই বলি –
যুক্তিকে বাঁচতে দাও
যুক্তিকে বাঁচতে দাও
যুক্তির স্বচ্ছ আলোয়
শানিয়ে নিচ্ছি আমার চোখ,
বিরোধীর যুক্তিটাও
বন্ধুরা আমল দাও
বিরোধীর স্বাধীনতাটাই
স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক।
সুস্পষ্ট দাবি করছি আসিফ মহিউদ্দীনের ব্লগ সাইট ফিরিয়ে দেবার, এবং ব্লগারদের বিরুদ্ধে বিটিআরসির উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা বন্ধের। এখনই।
* অভিজিৎ রায়: গবেষক, বিজ্ঞান লেখক এবং ব্লগার
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৩
এমএন/সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর