স্কুলভবনের পেছনেই কবরটি। সাধারণ কবরের চেয়ে বেশ বড়।
কবরভর্তি জংলিগাছ। যেন কোন পরিত্যক্ত জায়গা এটি। কবরে লাগোয়া একটি ক্লাসরুম। সেখান থেকে দু’একজন ছাত্র জানালা দিয়ে কবরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছে দুমড়ানো কাগজ আর টিফিনের উচ্ছিষ্ট। কোন সাইনবোর্ডও নজরে পড়ল না। ফলে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই যে এটি গণকবর। অথচ ১৯৭১-এ এখানেই দাফন করা হয়েছিল ১৭জন শহীদের রক্তাক্ত লাশ। স্কুলটির ছাত্র-শিক্ষকরাও জানেন না কি ঘটেছিল এখানটায়। অনাদর আর অবহেলায় এভাবেই অযত্ন ও অসম্মানে পড়ে আছে জেবি স্কুলের গণকবরটি।
গ্রামের নাম আলোকডিহি। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার একপ্রান্তে এ গ্রামটি। গ্রামের পশ্চিমপ্রান্তে ইছামতি নদীর তীরে বৃটিশ আমলে গড়ে ওঠে একটি স্কুল। নাম দেয়া হয় জেবি স্কুল। জান বক্স শাহ নামের এক দারোগা প্রতিষ্ঠা করেন বলেই স্কুলটির এমন নামকরণ হয়।
জেবি স্কুল প্রাঙ্গণটি সবার কাছে পরিচিত ছিল ঘাটেরপাড় হিসেবে। ১৯৭১ সালে এখানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আশপাশের গ্রামের নিরাপরাধ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন চালাতো। কখনও কখনও ঘাটেরপাড়ের মাটিতে পড়তো শহীদের রক্তের ছাপ। ফলে একাত্তরের পর জেবি স্কুলের ইতিহাসটিও যায় পাল্টে।
আব্দুল জব্বারের বাড়ি আলোকডিহি গ্রামেই। বয়স ষাটের মতো। জেবি স্কুলের সেই হত্যাযজ্ঞের তিনি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তার মুখ থেকে শুনি সে গণহত্যার ঘটনাটি।
“দিনটি ছিল রবিবার। কার্তিকের ৫ তারিখ। রমজানের সময়। ভোরের দিকে আমাদের গ্রামে আগুন দেয় খানেরা। প্রাণের ভয়ে আমরা পালিয়ে যাচ্ছি পাশের সাতনলা গ্রামে। পথেই ওঁত পেতে ছিল খানরা। হাত-চোখ বেঁধে তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায় ঘাটের পাড়ে।
সেখানে দেখি কয়েকশ লোক। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। চোখের সামনে লাইন করে দাঁড় করানো হয় ১৭ জনকে। সবাই যুবক বয়সী। ‘মুক্তি কোন হে’- বলে মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ করছিল খানেরা। কেউ কোন উত্তর দেয় না। হঠাৎ গুলির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পরে ১৭টি দেহ। কারো মাথা, কারো বুক কিংবা কারো মুখ রক্তাক্ত হয় ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে। মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে ঘাটের পাড়ের বাতাস।
লাশগুলোকে কবর দিলেই আমাদের মুক্তি। খানদের এমন প্রস্তাবে আমরা ছয়জন জেবি স্কুলে বড় গর্ত করি। অতঃপর রক্তাক্ত লাশগুলোকে টেনে নিয়ে গর্তের মধ্যে স্তুপ করে মাটি চাপা দেই। দু’একজন তখনও জীবিত ছিলেন। মৃত্যু যন্ত্রণায় আমাদের হাত খামছে ধরছিল তারা। ”
কীভাবে বেঁচে রইলেন? জব্বারের উত্তর, “সতেরটি মরা কবর দিছি হামরা। লাশগুলোকে কবর দেয়ার পর এক বিহারি আর্মি বলল, ‘ওই বাঙালি, লাইন করেগা তোমকো সুট করেগা’। হঠাৎ লাইন থেকে বদি নামে একজন দৌড়ে পালায়। খানরাও তার পিছু নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। সে সুযোগে আমি ঝাপ দেই পাশের নদীতে। ইছামতি নদী বুকে আগলে রেখে আমার প্রাণ বাঁচায়। ”
কান্না জড়ানো কণ্ঠে জব্বার বলেন, “দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছে তাদের কথা তো আমরা মনে রাখিনি। জেবি স্কুলের ভবনগুলো পাকা হয়েছে। কিন্তু এতো বছর পরও শহীদদের গণকবরটিকে সংরক্ষণ করা হয়নি। ”
মতিলাল কর্মকারের বয়স পয়ষট্টি। ইসবপুর ইউনিয়নের নৌখর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সেদিনের হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছে তার ভাই রবীন্দ্রনাথ কর্মকার ও মামা কামিনী কর্মকার। সে সময় তাকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদিনের কথা উঠতেই তিনি বলেন, “আমাকেও লাইনে দাঁড় করানো হয়। এক মেজর লাইনে দাঁড়ানো সকলকে দেখছিল। মুক্তিযোদ্ধার খোঁজ করছিল সে। আমার চোখে চোখ পড়তেই হঠাৎ বলে- ‘বেটা ভাগ’। ভাইয়ের জন্য আমি তার পা জড়িয়ে ধরে বলি, ‘বাবু , ও ছাড়া আমার কেউ নেই। ’ উত্তরে মেলে বুটের লাথি। আমি দূরে ছিটকে পড়ি। আমার ডান চোখটা ফেটে গলগলিয়ে রক্ত বেরোয়। ওই চোখে এখনও ঠিক দেখতে পাই না। ”
জেবি স্কুল গণকবরের শহীদদের নামের তালিকা সংরক্ষণ করা হয়নি সরকারিভাবে। সঠিকভাবে শহীদদের নাম জানাতে পারেনি জেলা ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদও। শহীদদের প্রতি এমন অবহেলা আমাদের বিবেককে রক্তাক্ত করে।
বাড়ি বাড়ি ঘুরে শহীদদের তালিকা করেছেন মতিলাল। শহীদরা হলেন- ধনপতি কর্মকার, নিরাশাদ কর্মকার, রবীন্দ্রনাথ কর্মকার, বিনত কর্মকার, কামিনী কর্মকার, রমানাথ কর্মকার, ধন কর্মকার, করুণা কান্ত কর্মকার, নগেন কর্মকার, মহেশ্বর শীল (নাটা), শওকত আলী, শাহাদাত আলী, বদিউজ্জামান। বাকিদের নাম এখনও অজ্ঞাত।
শহীদ শওকত আলীর কন্যা শাহনাজ ও পুত্র এন্তাজ আলী। তারা বললেন, স্বাধীনের পরে শহীদ পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার করুণ কাহিনি। অনাহারে, অর্ধাহারে কাটে অনেকের জীবন। শহীদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও তারা পায়নি অদ্যাবধি।
মুক্তিযুদ্ধের ৪১ বছর কেটে গেছে। জেবি স্কুল গণকবরে শহীদ হওয়া নিরীহ নিরাপরাধ মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরা হয়নি দেশবাসীর কাছে। উদ্যোগ নেয়া হয়নি গণকবরটি সংস্কারের। তৈরি হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। এ বড়ই লজ্জার, বড়ই দুঃখের।
কোন আর্থিক সহযোগিতা নয়, গণকবরটি সংরক্ষণ ও শহীদ স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি এবং শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতিদানের আশা নিয়ে আজও অপেক্ষায় আছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। আর এই আশাই তাদের একমাত্র ভেলা।
[সালেক খোকন : লেখক ও গবেষক]
বাংলাদেশ সময় : ১৭৪৪ ঘণ্টা, ২৫ মার্চ ২০১৩
সম্পাদনা : এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর