‘বোবার কোনো শত্রু নেই’ কথাটা সবসময় সত্যি নয়। বোবা যদি বদ হয়, কথায় কথায় থুথু ছিটায় তবে এমন অভদ্র বোবাকে কেউ মহব্বত করে না বরং উল্টা কিলায়।
এমন এক বোবা দেখে ছোট বেলায় নিজেগুণে শিখেছিলাম- কথাটা ঠিক না। ছোট বেলায় নিজে শেখা অনেক বিদ্যাই পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে ‘মুরুব্বিদের বচনই সত্য’।
অনেক মুনিঋষি সময় মতো বোবা রূপ ধারণ করতেন। জ্ঞানী সক্রেটিস, যখন তার স্ত্রী জানথিপি কানের পাশে ঘ্যান ঘ্যান করতেন, তখন তিনি ধ্যানে বসতেন। উদ্দেশ্য একটাই- কথা বাড়িয়ে লাভ কী বাপু? এই তো আমাদের দেশে বছর কয়েক আগে নির্বাচন কমিশনার এমএ আজিজের পদত্যাগের দাবিতে সবাই যখন সোচ্চার ছিলেন, ঢাকার ব্যবসায়ীরা যখন তার বাসায় কাঁচাবাজারের যোগান বন্ধ করে দিয়েছিলেন, দুবেলা সবজি খাইয়ে হলেও ছেলের জীবন বাঁচিয়ে রাখার জন্য বরিশালবাসী যখন ট্রাকভর্তি লাউ-কুমড়ো পাঠালেন, সেই দুর্দিনে সাংবাদিকদের ‘পদত্যাগ করবেন কি’ প্রশ্নের জবাবে এমএ আজিজ নীরব থাকতেন। ওই যে ফর্মুলা একটাই- বোবার কোনো শত্রু নেই। সময় সময় কথা না বলে বোবা হয়ে যাওয়াই উত্তম।
বোবা হওয়া কত জরুরি, বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্য শুনলে তার গুরুত্ব বুঝি। অতিকথনে তিনি পা পিছলে যেমন নিচে পড়ছেন, তেমনি নিজদল ও দেশকে পিছলে দিয়েছেন। ‘ছিয়ান্নব্বই টু দুইহাজার এক’ আমলে শেখ হাসিনার অতি কথায় যারা রুষ্ট হয়েছিলেন, খালেদাকে ধীরস্থির প্রজ্ঞাসম্পন্ন বলেছেন। তারাই আজ খালেদার কথায় কানে আঙুল বুজে চলেছেন।
এক কানে আর কত ‘অকথা’ শোনা যায়, বলেন তো!!
এই প্রায় শেষ বয়সে এসে খালেদা জিয়া হঠাৎ করে কথার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। শাহবাগের নাতিপুতি বয়সের ছেলেপুলেদের ‘নাস্তিক’ বলে গালি দিয়েছেন। জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষকে ‘গণহত্যা’ বলেছেন। শুনলাম, তিনি এ ঘটনার জন্য ‘ট্রাইবুন্যাল’ গঠন করবেন বলেছেন। সর্বশেষ রোববার বগুড়ার জনসভায় সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিয়ে বলেছেন- ‘সেনাবাহিনী চুপ করে বসে থাকবে না। সময়মতো কাজ করবে। ’
বেগম খালেদা জিয়া হঠাৎ করে কেন সেনাবাহিনীকে উস্কে দিতে চাচ্ছেন বুঝলাম না। তিনি কি মনে করছেন, সেনারা ক্ষমতায় এসে সাবেক ফার্স্ট লেডি হিসেবে ‘মা’ বলে সম্বোধনপূর্বক ‘কদমবুচি’ করে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দেবেন?
তিনি হয়ত ভুলে গেছেন, এর আগে সেনাসমর্থিত সরকার তার বড় ছেলের কোমরের হাড় ভেঙেছে, যে হাড় গত ছয় বছর ধরে পাশ্চাত্যের দেশে বসেও সারানো যাচ্ছে না। সেনারা ক্ষমতায় এলে ভবিষ্যত কেমন ঘনঘোর অন্ধকার সেটা বোধহয় তিনি ভুলে গেছেন!
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে উস্কানির অভিযোগ এই-ই প্রথম নয়। বেশ কিছুদিন আগে আমেরিকায় অখ্যাত ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশকে শায়েস্তা করার জন্য ওবামা সাহেব বরাবরে ইংরেজিতে চারকলম লেখা তার নামে প্রকাশিত হয়েছে। ভাগ্যিস! সে দেশে তেমন কেউ এই পত্রিকাটি পড়ে না। না হলে ওবামা সাহেব এত দিনে ‘দেশনেত্রী’র করুণ আর্তির চিঠির প্রতি করুণা দেখিয়ে হলেও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বঙ্গজয়ে রওয়ানা হতেন নিশ্চয়ই!
ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকাটি কেউ পড়ে না বলেই কূটনীতিক মহলে তেমন আলোচিত হয়নি বিষয়টি। সরকারও নীরব থেকেছে অনেকটা।
সাবেক এক সেনামুরুব্বি, সাবেক সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহ মন্তব্য করেছেন “উস্কানি দেওয়া ঠিক নয়”। তার কাছেও বিষয়টা উস্কানিমূলক মনে হয়েছে। আমার কাছে বেগম জিয়ার বক্তব্য যতটা না উস্কানমূলক মনে হয়েছে, তার চেয়ে ‘অতিকথন’ দোষে দুষ্ট মনে হয়েছে বেশি। রাজনীতিতে বেশি কথা বলা আমাদের দেশে প্যাশন।
সাবেক সেনাপ্রধান বিএনপি নেতা জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানও বলেছেন- খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য রাজনৈতিক, মাঠের বক্তব্য। বিএনপির এই নেতা নিশ্চয়ই জানেন, নেতার বক্তব্য মাঠে দেওয়া হোক আর খাটে দেওয়াই হোক, তার মধ্যে কোনো পার্থক্য আদৌ নেই। নেতা যেখান থেকেই বক্তব্য দিক, বক্তব্যের প্রভাব পড়বেই।
বিবিসি বাংলায় সোমবারে রিপোর্টে নাম না বলার শর্তে অনেক নেতাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
রাজনৈতিক জোশে বেগম জিয়ার বক্তব্যের আতিশয্য কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটা বেগম জিয়ার মতো বিশিষ্ট পদের ব্যক্তিত্বের বোঝার প্রয়োজন। এর আগে খালেদা-হাসিনাদের রাজনৈতিক ভুলে ওয়ান ইলাভেন-এর মতো ঝড় এসেছে।
এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য ভারী হওয়াই আমাদের কাম্য। তবে জনগণ কী চায়, কী বলে, তার ওপরই নির্ভর করে কথা বলা উচিত। জিহ্বার চাপে ‘অপ্রীতিকর’, ‘অপ্রত্যাশিত’ উদ্ভট কথা বলিলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বৈ কিছু হবে না। তাই, জিহ্বার ওপর চাপ কমিয়ে মাথার ওপর চাপ বাড়ানো উচিত। ধীরস্থির চিন্তা করা উচিত।
এধরনের বাকসর্বস্ব রাজনীতিকে জিহ্বার আস্ফালন বলে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ১২৮৯ সালে `ভারতী` পত্রিকায় “জিহ্বা আস্ফালন” শীর্ষক লেখায় লিখেছেন- ‘নিতান্ত বালকের মতো না বুঝিয়া না শুনিয়া কেবল অনবরত আবদার করিলে, ঘ্যানঘ্যান করিলে, চিৎকার করিলে, কে আমাদের কথায় কর্ণপাত করিবে? তাই বলিতেছি, আগে দেশের অবস্থা সম্বন্ধে উদাহরণ সংগ্রহ করো, ভাবিতে আরম্ভ করো ও বলিতে শেখো, তাহা হইলে আর সকলে শুনিতে আরম্ভ করিবে’- কথাটা এখনও প্রযোজ্য!
লেখক: মনোয়ার রুবেল
ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
ইমেইল: monowarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৩
এবি