প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও গবেষক প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম আজ আর নেই। এ কথা ভাবতে গিয়ে আমার খুব কষ্ট হয়।
১৯৮৬ সালে আমি ছিলাম অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার্থী, কমিটির সভাপতি ছিলেন স্যার এবং তখন তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। আমি যখন মৌখিক পরিক্ষা দেয়ার জন্য বোর্ডে উপস্থিত হই, তখন স্যার বোর্ডে ছিলেন এবং সেখানেই প্রথমবারের মতো স্যারের সাথে দেখা হয়। পরীক্ষার ফল বের হলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করি। পরবর্তীতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করি। এরই সূত্র ধরে স্যারের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ঘটে। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি শেষ হলে পাবনা ক্যাডেট কলেজে প্রথম চাকরি হয়। এই খুশির খবর প্রথমে স্যারকে জানালে স্যার বললেন, “তুমি এগুলোতে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমার চাকরি হলে ভালো হয়। ” স্যারের এ উপদেশ আমার মা-বাবাকে জানালে তারাও স্যারের কথামত চলার নির্দেশ দেন। পরে স্যারের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে তারই তত্ত্বাবধানে রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেথিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সে (আরসিএমপিএস) এমফিল ও পিএইচডি করি। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় স্যারের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। স্যার আমাকে তার পুত্রের মতো দেখতেন এবং সিলেট আসলেই স্যারকে আমি আমার বাসাতে নিয়ে আসতাম। যে ক’জন মনীষীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তার মধ্যে স্যার ছিলেন প্রথম। তার থেকে অনেক দীক্ষা পেয়েছি, এক অনুসরণীয় আদর্শ ছিলেন তিনি।
স্যার যখন কেমব্রিজ ছেড়ে চবিতে গণিত বিভাগে যোগ দেন, এতে ১৯৮৪ সালে একটি সাংবাদিক সম্মেলন হয়, ওই অনুষ্ঠানে অন্যদের সাথে আমিও ছিলাম। তখন সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্নœ করেছিলেন, কেমব্রিজের অনেক উচ্চ বেতনের অধ্যাপনার চাকরিটি ছেড়ে বাংলাদেশের চবির সামান্য বেতনে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিতে আসলেন কেন? এর উত্তরে তিনি বলেন, “আমার বাড়ি চিটাগং, এ জন্য এখানে জয়েন করি। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, আমি এখান থেকে নিতে আসিনি, আমি দিতে এসেছি। ” তার সাথে দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে আমি তাঁর এ কথার যথাযথ প্রমাণ পেয়েছি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৮৫ সালে যখন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আব্দুস সালাম চবিতে এসেছিলেন এবং এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “এশিয়ার মধ্যে আমার পরে যদি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার পান, তবে সে হবে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। ” এ কথা তিনি পরপর তিনবার বলেছিলেন।
আব্দুস সালামের সাথে যারা নোবেল পুরষ্কার পান তাদের মধ্যে Weinberg and others সম্পর্কে মন্তব্যে করতে গিয়ে বলেন, “we are particularly indebted to Jamal Islam, a physicist colleague now living in Bangladesh. For an early draft of his 1977 paper which started us thinking about the remote future”
আমি প্রায়ই স্যারের মুখে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন গবেষক ও বিজ্ঞানীদের নাম শুনতাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন স্টিফেন হকিং, জে ভি নারলিকার ও অমর্ত্য সেন। এর মধ্যে স্টিফেন হকিং স্যারের রুমমেট ছিলেন। স্যারকে দেওয়া স্টিফেন হকিং-এর অনেক চিঠি স্যার আমাকে দেখিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু জে ভি নারলিকার ও স্যার দুজনেই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন এবং তারা ইংল্যান্ড ও আমেরিকার বেশ কটি উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। পরে দুজনেই নিজ নিজ দেশে ফিরে এসে উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রফেসর জামাল চবিতে প্রতিষ্ঠা করেন আরসিএমপিএস এবং জে ভি নারলিকার প্রায় একই সময়ে ভারতের পুনাতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’। ২৪ ফেব্রুয়ারি স্যারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে মাঝে মাঝে সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে জে ভি নারলিকার তার বাসায় আসতেন।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে দি আল্টিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স (১৯৮৩) সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর তা বিজ্ঞানীমহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। এছাড়া তার রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি গ্রন্থটি ১৯৮৫ সালে কেমব্রিজ থেকে প্রকাশিত হয়। একই প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ। যা পরে স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়। তার অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত কৃষ্ণ বিবর এবং রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ। ডব্লিউ বি বনোর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪)। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বই স্যার আমাকে বিভিন্ন সময় দেন। উল্লিখিত গ্রন্থ ছাড়াও আরো অসংখ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফিল্ডের জার্নালে লেখা প্রকাশিত হয়। তার লেখা বই অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরি বিশেষ করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রব) লাইব্রেরিতে তার কোনো গ্রন্থ রাখা হয় নাই। যা পড়া থেকে বর্তমান শিক্ষার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন।
গত ৮-১৩ জানুয়ারি আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলাম, সেসময় স্যারের সাথে দেখা করতে যাই। তখনও স্যারকে সুস্থ দেখেছি। স্যার সাধারণত কোন রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ সেবন করা পছন্দ করতেন না। তবে স্যার যে কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত তা তিনি কখনো আমাদের বুঝতে দেননি। এই দেখাই ছিল আমার শেষ দেখা।
স্যারের স্ত্রী তার প্রতি খুবই যত্নশীল ছিলেন। উনাকে আমি খালা বলে সম্বোধন করতাম। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে স্যারের পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। দেশে-বিদেশে যে কোন জায়গায় স্যার গেলে খালা সব সময় স্যারের সঙ্গী ছিলেন। স্যারের দুই মেয়েও খুবই মেধাবী। খালাও ইংল্যান্ড থেকে ইতিহাসের উপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরসিএমপিএস-এ দায়িত্ব পালনকালীন স্যারের আমন্ত্রণে বিদেশের অনেক খ্যাতনামা বিজ্ঞানীরা এসে সেমিনার টক (আলোচনা) দিতেন, এটা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্যারও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতেন এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেমিনার টক দিতেন। তিনি ইংরেজি ছাড়াও সেমিনারে জাপানি, জার্মানি ভাষায় বক্তব্যে দিতেন আর এসবের ফাঁকে বাংলাও বুঝিয়ে দিতেন।
প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলামের এসব কৃতিত্বের সাথেও তিনি অসংখ্য মহৎ কাজ করে গেছেন। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে একবার সারা দেশে হরতাল চলাকালে আমিসহ দেশে-বিদেশের কয়েকজন গবেষক-বিজ্ঞানীরা চিটাগং-এর সদরঘাট এবং অন্যান্য হোটেলে ছিলাম। সকাল ১০টায় যখন আমরা স্যারের বাসায় হেঁটে পৌঁছি, তখন দেখতে পেলাম কয়েকজন গরিব বিহারী লোক স্যারের বাসার ফটকে। এসময় তারা আমাকে বললো, আমরা স্যারের কাছে আসছি। তাদের আমাদের কনফারেন্স-এর কথা বলে চলে যেতে বললাম, তারা না গেলে আমি স্যারকে ডেকে আনি। এসময় দেখলাম প্যাকেট থেকে স্যার কিছু দিলে তারা চলে গেলো। এ ঘটনায় আমরা অবাক হবার পাশাপাশি স্যারের স্ত্রীও অবাক হলেন। তিনি এ ঘটনার মাধ্যমে প্রথম জানলেন যে, স্যার বেতন পাওয়ার পর প্রতিমাসের একটা অংশ তাদের দিয়ে দিতেন। স্যারের স্ত্রী কৌতুক সহকারে আমাদের বললেন, “সংসার চালাচ্ছি আমি, কিন্তু প্রতিমাসের টাকা উনি আমাকে না দিয়ে গরিবদের বিলিয়ে দেন। ” তিনি প্রায়ই আমাদের বলতেন, “প্রকৃত অর্থে যারা দেশকে ভালোবাসে তারা যেমন, শিক্ষক শিক্ষকতার ফিল্ডে, ডাক্তার ডাক্তারি ফিল্ডে, কৃষক কৃষকের ফিল্ডে মনে প্রাণে কাজ করতে হবে। তখনি প্রকৃত অর্থে দেশকে গড়া যাবে। ”
এছাড়াও তিনি শিক্ষক থেকে শুরু করে গরিবদের বিভিন্ন বিপদ-আপদে উদারহস্তে সাহায্যে-সহযোগিতা করতেন।
স্যারের চরিত্রের আরেকটি বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করেছে তা হলো, স্যারকে চবির ভিসি হওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকবার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। স্যার প্রতিবারই বলেছিলেন, “আমার চায়ের কাপ রিসার্চ সেন্টারে, প্রশাসনিক অফিসে নয়। ”
জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনগ্রসরমান বাংলাদেশের মতো দেশে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন ‘ক্ষণজন্মা’ পুরুষ। এসব মানব কালেভদ্রে শুধু একবারই জন্ম নেন। রাজনৈতিক বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে তিনি সব সময় দেশ ও উচ্চ শিক্ষা গবেষণার কথা ভাবতেন। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের তথাকথিত লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির মতাদর্শী না হওয়ায় স্যারকে এদেশের সুশীল (!) সমাজ কখনো মূল্য দেয়নি। তিনি তৎকালীন সময়ের লক্ষ টাকার চাকরি ছেড়ে দেশ ও নাড়ীর টানে আসলেও এদেশের সরকারও তাকে মূল্যায়ন করেনি। তার মৃত্যুতে গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহল শোকে মুহ্যমান, সেখানে আমাদের তথাকথিত বোদ্ধারা শুধুমাত্র পত্রপত্রিকায় ছোট্ট বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখছেন। তাঁর গবেষণাধর্মী বিভিন্ন বই পুস্তক, জার্নাল উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য পুস্তকের প্রধান অংশ। সেখানে আমাদের নতুন প্রজন্ম তা থেকে ক্রমশ বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হওয়ার স্বার্থে আমাদের তথা আমাদের প্রজন্মকে ড. জামাল নজরুল ইসলামের মতো ব্যক্তিদের স্মরণ রাখতে হবে।
আর দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সকল জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আকুল আবেদন যে, সোনার বাংলার সোনার মানুষ এই মহান ব্যক্তির নামে কোন রিসার্চ সেন্টার যেন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
লেখক: প্রফেসর, গণিত বিভাগ ও সাবেক প্রক্টর
শাবিপ্রবি, সিলেট।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৩