বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক সহকর্মী ফোন করে জানালেন, ২৪ ঘণ্টার নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজে সাংবাদিকদের সোর্স বিষয়ে একটা লেখা আছে। লেখাটা পড়তে বললেন তিনি।
সাম্প্রতিককালে হরতালের আগের সন্ধ্যা এমনকি ভর দুপুরে গাড়িতে আগুন লাগানোর সংস্কৃতি শুরু হয়েছে। ঘরোয়া বৈঠকে, আড্ডায় সহকর্মীসহ অনেকের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছি। আমার মনে হয়, ‘গাড়িতে আগুন সংস্কৃতির জন্য অনেক ক্ষেত্রে আমরা সাংবাদিকরা দায়ী। ’ এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আবার শুরু হওয়া পুরনো সেই ‘ককটেল’ সংস্কৃতির জন্যও গণমাধ্যমকর্মীরা কিঞ্চিৎ দায়ী। অথচ এই দায় থেকে আমরা সহজেই মুক্ত হতে পারি। কিন্তু আমি বা আমরা যারা চাকরিতে খুব ছোট ‘ক্ষমতা’ ভোগ করছি তাদের কাছে দায়মুক্তির সেই ক্ষমতা নেই!
আমার মনে হয়েছে, গাড়িতে আগুন সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ার জন্য প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা মাঠে কাজ করি তারা নই, যারা গণমাধ্যমের এডিটর বা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে আছেন তাদের দায় বেশি । এই দায়মুক্তির জন্য উদ্যোগও নিতে পারেন টেলিভিশন ও পত্রিকার সর্বোচ্চ পদের ব্যক্তিরাই।
আমি চট্টগ্রামে কাজ করি। মাহমুদ মেনন যেভাবে বললেন, ‘সোর্স খবর দেয়, অমুক জায়গায় গাড়িতে আগুন দেওয়া হবে, চলে আসেন। ’ চট্টগ্রামেও এমনই। খবর পেয়ে আমরা ছুটে যাই। সবচেয়ে বেশি আগুনের ছবিটা দিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে ‘হরতালের আগেই গাড়িতে জ্বলছে আগুন। ’ সব জায়গায় একটা ভয় তৈরি হয়। ইদানিং ককটেল সংস্কৃতিও দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে আবার ফিরে এসেছে। হরতালের আগে ককটেল বিষ্ফোরণ চলছে। এসব দৃশ্য কার আগে কে দেখাব-এ নিয়ে চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। সময়ের একটু হেরফের কিংবা সহযোগী টিভির সঙ্গে কিঞ্চিৎ আগেপরে হলেই প্রধান অফিসের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শুনতে হয় প্রশংসা বা গালমন্দ।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, কেন আমরা গাড়িতে আগুনের ছবি দেখাই, খবর ছাপি। শুধু টেলিভিশনে দেখানোর জন্যই কিংবা পত্রিকায় ছাপানোর জন্য সাধারণ ও নিরীহ মানুষের গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে এটা কেন আমরা বুঝতে পারছি না। গািড়র আগুনে পুড়ে ইতোমধ্যে মানুষও মারা গেছে। আহততো হচ্ছেই। আমি মনে করি, আমরা যদি গাড়িতে আগুনের ছবি না দেখাই তাহলে আগুন দেওয়া আস্তে আস্তে কমে আসবে। ভাবতে হবে, তারা কেন গাড়িতে আগুন দেয়?
আমি নিশ্চিত, হরতালের আগের দিন ক্ষোভের কারণে নয়, ভীতি ছড়াতেই গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। যাতে টেলিভিশনে গাড়িতে আগুনের ছবি দেখলে মানুষ পরের দিন ভয়ে আর গাড়ি বের না করে।
সুতরাং এটা খুব সহজ যে, আমার যদি এসব ছবি বর্জন করি বা ঘোষণা দিয়ে না দেখাই তাহলে গাড়িতে আগুন দেওয়া বন্ধ হবে।
আমি জানি, অনেক টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন জ্বলন্ত গাড়ির ভালো ছবি দিতে না পারায় অফিসের উর্ধ্বতনদের কাছ থেকে বকা খেয়েছেন। তাই বসের বকা থেকে বাঁচার জন্য বা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য অনেকে দাউ দাউ করে জ্বলছে এমন ছবি তুলতে চেষ্টা করি। সম্পাদক পর্যায়ে যাঁরা আছেন তারাও সেই ছবির জন্য যেন উন্মুখ হয়ে থাকেন! ব্যবহার করেন খুশিমনে। এছাড়া সংবাদকর্মীদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ভাবনা যোগ হয়ে এই আগুনে ঘি ঢালে। যদিও এই ধরনের উদাহরণ খুব বেশি নয়। কারণ আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ব্যক্তি মানুষের বাইরে এসেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন।
টেলিভিশনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের অনেক সহকর্মী নাশকতা সৃষ্টিকারীদের শিখিয়ে দেন, ‘ওইটা এভাবে করেন, ওভাবে করেন। তাহলে ভালো কাভারেজ পাওয়া যাবে। ’ মানে নিউজ-ফুটেজটা কোনো কোনো সময় আমরাই তৈরি করি।
জানি না, ঠিক বলছি কি না। এ লেখায় আমি আমার ব্যক্তিগত ভাবনাটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় যারা পত্রিকা এবং টেলিভিশনের নীতি নির্ধারক, তারা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। কেবল ভীতি তৈরির জন্য গাড়িতে দেওয়া আগুনের ছবি দেখাবেন বা ছাপাবেন কি না। দেখালে বা ছাপালে কতুটুকু গুরুত্ব দিবেন।
আমি আবারো বলছি, শুধু টেলিভিশনে দেখানো বা পত্রিকায় ছবি ছাপানোর জন্য সাধারণ মানুষের গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। এতে মরছে মানুষ। এই সংস্কৃতি থেকে বের হবার এখনই উপযুক্ত সময়।
আলমগীর সবুজ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রতিনিধি, দেশ টেলিভিশন
বাংলাদেশ সময় ১৩১১ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৩
এমএমকে