ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

স্যান্ডউইচ সরকার আর শিক কাবাব জনগণ!!!

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৩
স্যান্ডউইচ সরকার আর শিক কাবাব জনগণ!!!

বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান অবস্থা হয়েছে অনেকটা স্যান্ডউইচের মত। একদিকে সরকার পতনের একদফা ইস্যু নিয়ে বিএনপির লাগাতার হরতাল অন্যদিকে ১৩দফা দাবি নিয়ে নাস্তিক-মুরতাদদের ফাঁসির দাবিতে ইসলাম রক্ষায় দৃঢ়সংকল্প হেফাজতে ইসলাম।

সেই সাথে স্যান্ডউইচের উপর অনবরত লবন-গোলমরিচের ছিটা দিয়ে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজাসহ জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে উত্তাল গণজাগরণ মঞ্চ!! মাঝে বেসামাল সরকারের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা!!!

গত ৫ ফেব্রুয়ারি আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে যে গণজাগরণ মঞ্চের শুরু হয়, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে বর্তমানে সেই আন্দোলনের ‍মূল দাবি হলো ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধকরণ। আর এই দাবি পূরণের লক্ষ্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য গণজাগরণের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার আগামী ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সেই সাথে এ কথাও জানিয়েছেন যে, সরকার দাবি না মানলে কঠোর কর্মসূচিতে যাবে গণজাগরণ মঞ্চ।

অন্যদিকে নিষিদ্ধ ইসলামী সংগঠনের উস্কানিতে ব্লগার রাজিবের খুনের ঘটনার পর হঠাৎ করেই নাস্তিকতা ইস্যু দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় যে, সংঘবদ্ধ কোনো একটি মহলের মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে এই ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, গণজাগরণ মঞ্চের মূল শক্তি যে ব্লগারেরা তাদের অনেকেই নাস্তিক। অথচ সেখানে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষের সরব উপস্থিতির ব্যাপারটা চেপে যাওয়া হয়। নাস্তিকতা ইস্যুর উপর ভিত্তি করেই ইসলামকে রক্ষার নাম করে গড়ে তোলা হয় তোলেন হেফাজতে ইসলাম।
 
শুরুতে গুটিকয়েক তথাকথিত ‘নাস্তিক’ ব্লগারকে (যাদের মধ্য কেউ কেউ দীর্ঘদিন হলো ব্লগ লিখছেই না) প্রতিহত করার কথা বললেও ধীরে ধীরে হেফাজতে ইসলাম তাদের দাবি দাওয়া বাড়াতে বাড়াতে এখন ১৩টিতে দাঁড় করিয়েছে।    
 
সরকারের কাছে তাদের ১৩ দফা দাবির মধ্যে আছে: আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানের বিরুদ্ধে কুত্সারোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করা।
 
হেফাজতে ইসলাম গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রদের সাথে নাস্তিক ইস্যু নিয়ে কোনো রকম আলোচনা করতেও এর আগে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ওলামা-মাশায়েখদের যদি মনে হয়ে থাকে যে, গণজাগরণ মঞ্চের ওরা ইসলামের বিপক্ষে ভুল পথে চালিত, তাহলে তাদের সাথে আলোচনা করে তাদের ভুল শুধরে দেয়াটাই কি ওলামা-মাশায়েখ বুজর্গদের কাজ নয়? যদি কেউ ভুল পথে চালিত হয় বলে মনে হয়, তবে তাদের কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে সরাসরি ফাঁসি দেয়াটা কি ইসলাম সমর্থন করে?
 
হেফাজতে ইসলামের মূল দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ত্বরিতগতিতে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোববার সন্ধ্যায় গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের মুলতবি সভায় সূচনা বক্তব্য দেওয়ার সময় বলেন যে, ধর্মীয় অনুভূতিতে যারাই আঘাত হানছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতেও একইভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সুস্পষ্টভাবে  তিনি উল্লেখ করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন আমরা অলরেডি দেখতে পাচ্ছি। এরই মধ্যে ফেসবুক, ব্লগসহ যেখানে যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করা হয়েছে, সেগুলো সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।

এই সব সিদ্ধান্ত যে, সরকারের গায়ে বাকশালী লেবেল লাগিয়ে দিচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের মাঝে বীতশ্রদ্ধার জন্ম দিচ্ছে সেসব কিছুকে উপেক্ষা করে সরকার হেফাজতে ইসলামের দাবির সাথে একাত্ম হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে!!
 
এত কিছুর পরেও হেফাজতে ইসলাম আগামী ৬এপ্রিল ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আবার এও হুমকি দিয়েছে যে, তাদের লং মার্চে বাধা এলে তারা লাগাতার হরতাল দিয়ে দেশ অচল করে দেবে।

হেফাজতে ইসলামের মুখপাত্ররা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন যে তাদের আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ধর্মীয় একটি আন্দোলন। এর সঙ্গে নাকি রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
 
কিন্তু তাদের বর্তমান কার্যক্রম দেখে আমাদের ধর্মপ্রেমি সাধারণ জনগণের বুঝতে বাকি থাকে না যে, তাদের দাবিকৃত অরাজনৈতিক আন্দোলন ক্রমশই রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের ন্যায় সহিংস আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা রাজনৈতিক দলের মতই বিভিন্ন দাবি দাওয়া উত্থাপন করে সরকারকে সাহায্য করার বদলে চাপে রাখার কৌশল গ্রহণ করছে।
 
বিএনপি-জামাতের ক্রমাগত হরতাল, ৪ তারিখের পর গণজাগরণের কঠোর আন্দোলন, ৫ তারিখের পর হেফাজতে ইসলামের কঠোর আন্দোলন এত এত আন্দোলনের চাপে পড়ে সরকারের অবস্থা যখন স্যান্ডইউচের মত, দাবি দাওয়ার চাপে যখন সরকারের শ্বাস নেয়াও কষ্টকর হয়ে পড়ছে, তখন আমরা আম-জনতা প্রিয় এই দেশটাকে ভালোবেসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ককটেল আর পেট্রল বোমায় পুড়ে শিক কাবাব হয়ে যাচ্ছি।
 
দেশের অর্থনীতি থমকে আছে, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বসে পড়ছে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বেড়ে জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ কাণ্ডারি সবাই জনগণের কাধে বন্দুক রেখে আন্দোলনের নতুন নতুন দাবি-দাওয়া ঠিক করা নিয়ে অতিব্যস্ত সময় পার করছে।    
 
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে রাষ্ট্র আর জনগণ তো সুস্বাদু খাবারের মতই। হোক না সে স্যান্ডউইচ বা শিক কাবাব, তাদের আগ্রাসী ক্ষুধা মিটলেই তো হলো!!! চুলায় যাক জনগণ, কর্পুরের মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাক দেশপ্রেম। তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কারও কোনো কিছু কি যায় বা আসে?
zinia-zahid-
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্লগার।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৩
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।