আমাদের ছোট বেলায় জেলা শহরে এমন অনেক পরিবার ছিলো যাদের কথা প্রায় পুরো শহর জানতো। শিক্ষক বা চিকিৎসক অথবা প্রকৌশলী কিংবা সরকারি কর্মকর্তা বাবা আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গৃহবধূ মায়ের সন্তান যারা স্কুলের ফার্স্ট বয় অথবা সেকেন্ড গার্ল কিংবা প্রাইমারি অথবা জুনিয়র বৃত্তি পাওয়া।
ওইসব বাড়িতে পড়ার মতো অনেক বই থাকতো, গান শোনার ব্যবস্থা ছিলো, নিজেদের গাইবার জন্যও থাকতো হারমোনিয়াম কিংবা বাজানোর জন্য গিটার। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের কেউ কেউ খেলাধুলায়ও ভালো, কেউ আবার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা অথবা রচনায় ফার্স্ট-সেকেন্ড। বাড়ির ছেলেদের মসজিদে যাতায়াতও ছিলো প্রায় নিয়মিত।
তবে ওই পরিবারগুলোর সবাইকেই স্কুলের অন্যরা খুব ভালো করে চিনতো সব ভাই-বোনেরই ভালো রেজাল্টের কারণে। এসএসসি কিংবা এইচএসসির রেজাল্টের পর নিজেদের পাড়া-মহল্লা ছাপিয়ে শহরের অন্যদের কাছেও ছড়িয়ে যেতো তাদের সুনাম। সবাই জানতো অমুক সাহেবের ছোট ছেলে এবার স্টার মার্কস পেয়েছে, বড়টা আগেরবার অল্পের জন্য স্ট্যান্ড করতে পারেনি; তবে ছোট যে মেয়েটা সামনে পরীক্ষা দেবে সে স্ট্যান্ড করবেই। এসব আলোচনা চলতো ওইসব পরিবার আর তাদের সন্তানদের নিয়ে।
এরকমই একটি পরিবার ছিলো ময়মনসিংহের দ্য এডওয়ার্ড ইন্সটিটিউশনে সহপাঠী তুহিনদের বাড়িতে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে এখন ইউএনডিপিতে কাজ করছে জাহিদুল ইসলাম তুহিন। আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন তার বাবা ডাক্তার শওকত আলী সিভিল সার্জন। তুহিনের ছোট বোনও এখন ডাক্তার। তাদের বৃহত্তর পরিবারে চিকিৎসক আরো অনেকে। বাংলাদেশে আরো অনেক পরিবারে এরকম অনেক ডাক্তার, এরকম প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সংখ্যা হাজার হাজার। তাই মধ্যবিত্ত ওই পরিবারটির আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হওয়া তাদের নিজেদের জন্য খুব সুখের হলেও সবার জানার বা আলোড়িত হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়।
তারপরও এই চিকিৎসক পরিবারটির কথা এখন বাংলাদেশের অনেকেই জেনেছেন। দুঃখের বিষয় কোনো সুসংবাদের জন্য তাদেরকে এই চেনাজানা নয়, এক চরম ট্র্যাজেডির জন্য তাদের পরিচিতি; যে ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছেন কয়েকজন চিকিৎসক। পরিবারের অভিযোগ, ওই চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসা এবং অবহেলায় মৃত্যুবরণ করেছেন চিকিৎসক পরিবারটির বড় সন্তান ডাক্তার এ ই এম মাজহারুল ইসলাম ইমরান।
আমাদের চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড় ছিলেন ইমরান ভাই। আমরা যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র তখন তিনি ৯ম শ্রেণীতে। এসএসসি-এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে, আমাদেরকেও ভালো রেজাল্টের পথ দেখিয়ে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে চিকিৎসক হয়েছেন এই পর্যন্তই জানা ছিলো আমাদের। এমবিবিএস করে এরপর তিনি কি করছেন, চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম না দুর্নাম সেসব আর জানতাম না।
তার সম্পর্কে যখন আরো বেশি জানার সুযোগ এলো তখন তিনি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে আমাদের আরেক বন্ধু কবির মোহাম্মদ মঞ্জুরুল বারী, যে ইমরান ভাইয়ের আত্মীয় এবং একটি বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা, ফোনে জানালো; ভুল অপারেশনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইমরান ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। তখনই জানতে পারলাম ইমরান ভাই নিজেও একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে কিছুদিন আগে প্রমোশন পেয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে যোগ দিয়েছেন।
ইমরান ভাইয়ের ছোট ভাই এবং স্কুল জীবন থেকে আমার বন্ধু তুহিনকে যখন ফোন করলাম তখন ওই প্রান্ত থেকে কিছু কথা শুনতে পারলেও তার পুরোটাই ছিলো কান্না। তার কথায় স্পষ্ট, এখন একমাত্র প্রার্থনাই তাকে বাঁচাতে পারে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটাল থেকে জানানো হয়েছে ঢাকার আইসিইউতে যে চিকিৎসা চলছে এর বাইরে আর কিছু করার নেই।
সন্ধ্যায় অনেক অনেক বছর পর ইমরান ভাইকে দেখলাম, তখন তিনি কিছু যন্ত্রের মধ্যে শুধু তার শেষ অস্তিত্ব জানাচ্ছেন। চিকিৎসকরা স্পষ্ট করেই আমাদের বলেছিলেন, তাকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ১০ ভাগ। তারপরও স্কুলে ইমরান ভাইয়ের জুনিয়র আমরা কয়েক বন্ধু যখন হাসপাতাল থেকে বিদায় নেই, তখন তুহিনকে বলে এসেছিলাম, আবার যখন আসবো তখন ইমরান ভাই অনেক সুস্থ থাকবেন; তখন পর্যন্ত কথা বলতে না পারলেও আমাদের দেখবেন, যার চোখ খোলার অপেক্ষায় তার তিন সন্তান, স্ত্রী, মা-বাবা, ভাই-বোন।
বাস্তবতা যাই হোক তবু মনে মনে আশা ছিলো হয়তো ইমরান ভাই ফিরে আসবেন। হোক ১০ ভাগ সম্ভাবনা তবুতো তা এক ভাগের ১০ গুণ। কিন্তু স্বজনদের সব ভালবাসা-প্রার্থনা আর চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে শেষ পর্যন্ত জানুয়ারির ৩ তারিখ চিরঘুমের দেশেই চলে গেছেন ইমরান ভাই। তিন মাস হয়ে গেলো তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।
জীবনে মৃত্যু এক স্বাভাবিক ঘটনা, যতো কষ্টই হোক সেই মৃত্যু আমাদের মেনে নিতে হয়। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে তখন থেকেই জেনেছি এবং বুঝেছি এটাই বাস্তবতা। দেড় বছর আগে মায়ের চলে যাওয়ায় সব হারানোর বেদনায় অশ্রুসিক্ত হলেও এই ভেবে সান্তনা খুঁজেছি যে তিনি ৮০ বছরের বেশি সময় ভালবাসার মধ্যে বেঁচেছিলেন। মায়ের মৃত্যু সারাজীবনের জন্য নীরব কান্না আর গভীর এক শূন্যতা হলেও বাস্তবতাই সেখানে সান্তনা।
কিন্তু মাত্র ৪৫ বছর বয়সে চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসায় চিকিৎসক ইমরান ভাইয়ের মৃত্যুতে কোথায় সান্তনা খুঁজবেন তার চিকিৎসক পিতা, চিকিৎসক স্ত্রী এবং চিকিৎসক বোন? এভাবে চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু শোক কিভাবে কাটিয়ে উঠবেন ইমরান ভাইয়ের মা? তার তিন শিশু সন্তান? তার ছোট ভাই তুহিন?
তাদের এই ব্যক্তিগত শোক কাটিয়ে উঠার উপায় কারো জানা নেই। তবে একটি চিকিৎসক পরিবার হিসেবে তাদের মনে আজ যে প্রশ্ন সেই প্রশ্ন পুরো বাংলাদেশের। এভাবে ভুল চিকিৎসা আর চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যুর জবাব কি?
তুহিনসহ অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, কিছুদিন আগে এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে যোগ দিলেও পাইলস অপারেশনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ঢাকায় থাকার সময় তিনি যেখানে কনসালটেন্সি করতেন, সেই বেসরকারি গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালকে। ওই হাসপাতালে বারডেমের অধ্যাপক ডাক্তার আবু জাফর এবং অ্যানেসথেসিস্ট ডাক্তার মাহবুবুল হাসান মুনিরের তত্ত্বাবধানে অপারেশন হয় তার। পরিবারের অভিযোগ, অপারেশনের সময় ভুল এবং পরে উপযুক্ত যতœ না নেওয়ায় তার শ্বাস বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাক হলে ব্রেন ড্যামেজ হয়। তারা পরে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল থেকে ইমরান ভাইকে নিয়ে আসেন ল্যাবএইড হাসপাতালে যেখানে ব্যর্থ হয় চিকিৎসকদের সব চেষ্টা।
ইমরান ভাইয়ের স্বজনরা বলেছেন, সহকর্মীর কাছ থেকে বাড়তি টাকা নিতে পারবেন না তাই তার অপারেশনের পর চিকিৎসকরা অন্যদের অপারেশনের দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। ডাক্তাররা খেয়াল না করাতেই অপারেশনের পর তার হার্ট অ্যাটাক হয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে ডাক্তার ইমরান শত শত হৃদরোগীর চিকিৎসা করেছেন, অ্যানেসথেশিয়ায় ভুলের জন্য পোস্ট অপারেটিভে তিনি যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হন তখন সেখানে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক কিংবা নার্সও ছিলেন না।
ইমরান ভাইয়ের মৃত্যুর দিনই সরকারের জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের পরিচালককে প্রধান করে গঠিত ৫ সদস্যের সরকারি কমিটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইলসের অস্ত্রোপচারে ডাক্তার ইমরানকে পুরোপুরি অজ্ঞান করা ছিলো ভুল সিদ্ধান্ত। অস্ত্রোপচারের পরও অবহেলা ছিলো যে কারণে ডাক্তার ইমরান গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তার আবু জাফর এবং ডাক্তার মাহবুবুল হাসান মুনিরসহ হাসপাতালটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। এছাড়া ল্যাবএইড হাসপাতালের সব খরচ যাতে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল বহন করে সেই সুপারিশও করে কমিটি।
এই তদন্ত কমিটির সুপারিশ কার্যকর হওয়ার কোনো লক্ষণ গত তিন মাসে দেখিনি। কার্যকর হলেও কোনোভাবেই তা ইমরান ভাইকে আর ফিরিয়ে আনবে না, যতো শাস্তিই হোক কিংবা যতোই চিকিৎসা খরচ বহন করা হোক, কোনোকিছুই তার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হতে পারবে না। যে মাকে সন্তানের মৃত শরিরে আদরের শেষ ছোঁয়া দিতে হয়েছে, যে বাবাকে সন্তানের মরদেহ কাঁধে বহন করতে হয়েছে, যে সন্তানরা শৈশবেই প্রিয় বাবাকে হারিয়েছে; কান্না ছাড়া আর কি আছে এখন তাদের?
জানি না চিকিৎসকদের ভুল আর অবহেলায় একজন চিকিৎসকের মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের আর্তনাদ অন্য চিকিৎসকরা শুনতে পারছেন কি না। সরকারি হাসপাতালে হাজারো সমস্যার মধ্যে চিকিৎসকরা রোগিদের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও শুধু টাকার নেশাতেও ছুটছেন অনেক চিকিৎসক। তাদের এই অমানবিকতার শিকার হয়ে গেলেন ইমরান ভাই, যাকে তার মৃত্যুশয্যায় দেখতে ফরিদপুর থেকেও ছুটে এসেছিলেন তার অনেক রোগি; যারা বলেছেন, হৃদয় দিয়ে হৃদরোগিদের চিকিৎসা করতেন ডাক্তার ইমরান।
জাহিদ নেওয়াজ খান, বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই; (znewaz@gmail.com)