ভূপৃষ্ঠ থেকে ওজোন স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমন্ডলে বিদ্যমান আলো, বাতাস, পানি, শব্দ, মাটি, পাহাড়, নদ-নদী সাগর, মানুষের গড়া অবকাঠামো, রাসায়নিক পদার্থ এবং গোটা উদ্ভিদ ও জীব জগতের সমন্বয়ে যা সৃষ্ট তাই পরিবেশ।
এই পরিবেশের অংশ মানুষ পরিবেশ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেই বেঁচে আছে।
ভূপৃষ্ঠে পানির সঙ্কট। এ সঙ্কটের পেছনের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, প্রচুর পানি উত্তোলন, নদী-খাল শুকিয়ে যাওয়া বা দখল হয়ে যাওয়া এবং জলাদার দুষন। পানির সংকট এত বেশি যে এখন বুড়িগঙ্গার পানিও শোধন করে এত পানির সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ঢাকার আশেপাশের নদির পানি এতই দূষিত যে, তা পরিশোধন যোগ্যতা হারিয়েছে অনেক আগেই। আর এ কারনে হয়তো অচিরেই বিশুদ্ধ পানির জন্য একটা বিশাল সঙ্কট ঢাকাবাসীর জন্য অপেক্ষা করছে। ঢাকার আশেপাশের নদীগুলোর নাব্যতা হারিয়েছে। খালগুলো দখল হয়ে গেছে। আর বর্ষা এলে অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামেও তেমনি নদীর পানির প্রবাহ পর্যাপ্ত না থাকার কারণে পানি সঙ্কট দেখা দিতে পারে। যতই নগরের ওপর চাপ বাড়বে পানির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ততই অনিশ্চিত হবে।
উত্তরাঞ্চলসহ পুরো দেশের নদীগুলোর উৎস অন্য দেশে হওয়ায় নদীগুলো আমাদের নিন্ত্রণের বাইরে। যেমন গঙ্গার দৈর্ঘ্য প্রায় ২ হাজার ৪শ কিলোমিটার। এই নদীটির মাত্র ৫শ ৫০ কিলোমিটার বাংলাদেশে। এখানে এর নাম পদ্মা। এই পদ্মাকে কেন্দ্র করে বিশাল কৃষিজোন তৈরি হয়েছে। এর অনেকগুলো শাখা-প্রশাখাও রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর ও বাগেরহাটে অসংখ্য নদী, বিল হাওর রয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে শুষ্ক মৌসুমে ভারত পানি না ছাড়ার কারণে এদিকে মরুর মতো হয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিলে প্লাবন হয়ে যায়। ভারত বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পর্যাপ্ত মজবুত নয় বলেই দিনে দিনে ভারত বাংলাদেশের চতুর্দিকে অনেকগুলো ছোট-বড় বাঁধ নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) বর্তমানে অকার্যকর রয়ে হয়ে আছে। ইদানিং আসামের বরাক নদী থেকে অন্য শাখানদীগুলোর পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে এবং জল-বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ভারত টিপাইমুখে নির্মাণ করছে বাঁধ। এক্ষেত্রে ভারত কোনো প্রকার আন্তর্জাতিক নদী আইন না মেনেই এটি জারি করছে। অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটা, নদীগুলো নাব্যতা না থাকার কারণে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষিভূমি রয়েছে। কৃষি ভূমিগুলো হারাচ্ছে তাদের উৎপাদনক্ষমতা। এ পরিবর্তনে মরু অঞ্চল তৈরি হচ্ছে, গাছ মরে যাচ্ছে। এতে করে সমুদ্রকূলবর্তী অঞ্চল বিলীন হবে। আর আমরা হারাব আমাদের শেষ আশ্রয় বসত বিটা।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ খাবার পানির জন্য হাহাকার করছে। খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলের নদীর পানির উৎসগুলো প্রায় মৃত। বিপর্যস্ত কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের কলকারখানাগুলো নদীকে অতিরিক্ত অনাচারের ফলে নদী আজ দূষণের কবলে। দুই তীরের খুব নিকটে প্রায় ১০০০টি কলকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে দেড়শটি বৃহৎ কারখানা। এগুলো মূলত: কালুরঘাট, নাসিরাবাদ, ষোলশহর, পতেঙ্গা, কাপ্তাই, ইপিজেড এলাকায়। কলকারখানার বর্জ্য ফেলার সঠিক নীতিমালা থাকলেও প্রশাসনের গাফলতির কারণে নদীতে অবাধে কলকারখানাগুলো বর্জ্য ফেলছে। তেল শোধনাগার, বিটুমিন প্ল্যান্ট, টিএসপি প্ল্যান্ট, কর্ণফুলী পেপার মিল, সিইউএফএল, কাফকো সহ আরও অনেকে নদীতে অবাধে কলকারখানাগুলো বর্জ্য ফেলছে। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নজিরবিহীন উদ্ভাবন পরিবেশকে দূষিত করছে প্রতিনিয়ত।
গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে ডুবে যেতেপারে বাংলাদেশ। এর একটি সারণী এভাবে ধারণা করে প্রকাশ করা হয়েছে। যদি পৃথিবীর ভূভাগের তাপমাত্রা ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ ০.২৩ মিটার বেড়ে যাবে। যদি ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ ০.৫২ মিটার বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানিদের মতে জ্বালানী তেলের বিকল্প সন্ধান করা প্রয়োজন। নইলে পৃথিবীর ভূভাগের তাপমাত্রা মারাত্মক বেড়ে যাবে। হয়তো তা ৫.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। যা আগামী একশ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠ ২ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ প্রায় ১০০০ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি পানির নিচে চলে যাবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। পরিবেশ উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার-টেকনাফ সহ সমুদ্রউপকূলবর্তী কিছু এলাকা সাগরগর্ভে চলে গেছে। এর ফলে দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে নানাভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে। গাছ কেটে, জলাশয় ভরাট করে, যেখানে সেখানে ময়লা/বর্জ্য ফেলে দিনদিন আমরা নিজেরাই আমাদের চারপাশকে দুষিত করে ফেলছি। প্রতিনিয়ত গাছ কাটা ও বিভিন্ন কারখানা থেকে বের হওয়া ভয়াবহ ক্ষতিকর বর্জ্য ও ধোঁয়ার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রতিদিন বাড়ছে। এর ফলে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া, দুষিত হচ্ছে বাতাস ও পানি, কমে যাচ্ছে বৃষ্টিপাত। অতিরিক্ত পানির অপচয়ের কারনে মাটির নীচের পানির স্তর নেমে যাচ্ছে অনেক নীচে।
এই জখন অবস্থা তখন আমাদের সরকার একটি পানি আইন করতে যাচ্ছে। পানি রাষ্টিয় মালিকানায় জনগনের সম্পদ। এ সম্পদের ব্যবহার রাষ্টের সকল নাগরিকের সাংবিদানিক অদিকার। পানিকে বাণিজ্যিক পণ্য এবং রাজস্ব আয়ের উপকরণ হিসেবে না দেখে জননিরাপত্তা ও জনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ হিসেবে দেখা প্রয়োজন। রাষ্টের জনগণ যেন সহজে এই সেবা পেতে পারে সেদিকে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। আন্তর্জাতিক নদী সমূহের জন্য রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। পানি সংকট মোকাবেলায় এখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার। এখনি সচেতন না হলে পৃথিবী হয়ত একদিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামনে দাঁড়াতে পারে শুধুমাত্র পানির জন্য। তাই সবচেয়ে বড় দরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সমঝোতা তৈরি করা। আঞ্চলিক ফোরামে এসব নিয়ে কথা বলা। মোদ্দা কথা, সচেতন হতে হবে। পরিবেশকে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে ছেড়ে দিতে হবে।
লেখক: উন্নয়ন গবেষক, ঢাকা।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৩, ২০১৩
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর