ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

হরতাল কোনো মামুলি কর্মসূচি নয়!

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৯, ২০১৩
হরতাল কোনো মামুলি কর্মসূচি নয়!

সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক চলমান বিভিন্ন ইস্যুর উপর অনেক খোলামেলা আলোচনা করেন। তবে আজকে আমার লেখার আলোচ্য বিষয় হলো নিম্নের সাক্ষাত্কার অংশটি যা আমি দৈনিক প্রথম আলো থেকে হুবহু তুলে এনেছি।



"বিবিসি: দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামী হরতাল দিচ্ছে। হরতাল করছে দেশটির প্রধান বিরোধী দলও। এখন ইসলামপন্থীরাও হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। তাহলে বাংলাদেশ কি এখন সন্ধিক্ষণ (ক্রসরোড) পার করছে?

শেখ হাসিনা: অবশ্যই না। হরতাল খুবই মামুলি কর্মসূচি। আর এটা তো একটা স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশ। যে কেউ চাইলে তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারে। আমরা কাউকে থামিয়ে দিই না। সব সময়ই তাদের সুযোগ দিই। কারণ, কর্মসূচি পালনের অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু আমরা শুধু জনগণের জানমাল রক্ষার চেষ্টা করি। জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখতে চাই। এ ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বিনীতভাবে প্রশ্ন করতে চাই, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হরতাল কি খুব মামুলি একটি কর্মসূচি?" যে কেউ চাইলেই স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশকে হরতালের মত মামুলি কর্মসূচি দিয়ে রুদ্ধ করে দেবে? সবাইকে হরতাল করার সুযোগ দিতে হবে?
 
হরতাল নামক "মামুলি এই কর্মসূচি"র মামুলি গুটিকয়েক প্রভাব নিয়ে চলুন তবে কিছু আলোকপাত করি।
 
হরতালের ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে মামুলি কিছু পরিসংখ্যান যা দেশের জনপ্রিয় কিছু দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে তার চৌম্বক অংশ নিচে তুলে ধরলাম।

১। অর্থনীতি (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৯ এপ্রিল, ২০১৩ প্রকাশিত): একের পর এক হরতালে দেশের ব্যবসা বাণিজ্য ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। ফলে শুরু হয়েছে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ। এ অবস্থা চলতে থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে আসবে না। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। হরতালের সরাসরি প্রভাব দেশের রাজস্ব আদায়ে দেখা দিয়েছে। হরতালে বিপর্যন্ত বাণিজ্যের কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে।
 
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, হরতালের কারণে প্রতিদিন ক্ষতি হয় ছয় কোটি মার্কিন ডলার। এ হিসাবে টাকার অঙ্কে দৈনিক হরতালের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) হিসাব অনুযায়ী, বাজার মূল্যে বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ নয় লাখ ১৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এতে প্রতিদিনের জিডিপির পরিমাণ দাঁড়ায় তিন হাজার ৯০ কোটি টাকা। তাহলে একদিনের হরতালে মোট ক্ষতি হয় তিন হাজার ৯০ কোটি টাকা।

প্রতিদিন ব্যবসা থেকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক দিনের হরতালে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় ৩৭৯ কোটি টাকা।
 
২। শিক্ষা ব্যবস্থা (দৈনিক প্রথম আলো, ৯ এপ্রিল, ২০১৩ প্রকাশিত) হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষ শুরুর পর থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে পারছে না। হরতালের কারণে একের পর এক ক্লাস-পরীক্ষা পেছানো হচ্ছে। ফলে সেশনজট বাড়তে শুরু করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

(দৈনিক সমকাল ২৬ মার্চ, ২০১৩ প্রকাশিত) শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, “ক্রমাগত হরতাল কর্মসূচিতে সারাদেশের প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এ নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়েও দুঃশ্চিন্তা রয়েছে। ”
 
তিনি বলেন, হরতালের মতো বিবেকহীন কর্মসূচি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করছে। এটি একটি অচল ও গণবিরোধী কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন আর হরতাল ভালোভাবে নেয় না। তিনি শিক্ষার্থীদের মঙ্গল ও কল্যাণ চিন্তা করে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিহার করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।

৩। যোগাযোগ ব্যবস্থা (দৈনিক সংবাদ, ১৩ মার্চ, ২০১৩ প্রকাশিত): দেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হরতাল, সহিংসতায় যোগাযোগ খাতে মোট বিশ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, “সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হরতাল সহিংসতায় শুধুমাত্র বিআরটিসির-ই ৮১টি বাসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। যার ক্ষতির পরিমাণ তিন কেটি ৫৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে সারা দেশে সর্বমোট ৫২৫টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। যার ৮৯টিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বেসরকারিভাবে এর ক্ষতির পরিমাণ ১৭ কোটি টাকা। ”

৪। পর্যটন খাত (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ৯ এপ্রিল ২০১৩ প্রকাশিত): ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি ও দ্য গাইড ট্যুরস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মনসুরের সাক্ষতকারে জানতে পারি যে, “হরতালে অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। । গত ৩০/৩৫ বছরে পর্যটন নিয়ে এতটা আশাহত হইনি, এবার হয়েছি। জনগণের কথা কেউ ভাবছে না। সাম্প্রতিকালের হরতালের ক্ষতি ২০১৪ সালেও পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে নয়। বিগত এক মাসের হরতালে ৫০০ পর্যটককে আমরা সেবা দিতে পারিনি। হরতালের কারণে তারা দুর্ভোগে পড়েছেন। এ কারণে আমার নিজের প্রতিষ্ঠান ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা রাজস্ব আয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ”

হরতালে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের কথা এবং তাদের ক্ষয়-ক্ষতির কথা না হয় বাদই দিলাম, তারপরও কি উপরোক্ত পরিসংখ্যানুযায়ী হরতাল কে খুবই মামুলি মনে হয়?

এরপরও যদি মনে হয় “হরতাল খুবই মামুলি কর্মসূচি”, গণতান্ত্রিকতার অজুহাতে যে কেউ হরতাল দিতে পারে তবে আসলেই ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে আমাদের আর কিছুই বলার নাই।

হরতাল নামক খুবই মামুলি কর্মসূচি টিকে থাকুক আজীবন। জয় হরতাল!! হরতাল জিন্দাবাদ। হেফাজতে হরতাল!!
Zinia-Zaheed
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্লগার

 বাংলাদেশ সময়: ১৪২৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।