ইতিহাসের মীমাংসা না হলে ইতিহাস অগ্রসর হয় না। তাই একাত্তর নিয়ে প্রশ্নের রাজনৈতিক মীমাংসা আমাদের সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জরুরি শর্ত।
হেফাজতে ইসলাম সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত অংশের মাদ্রাসার ছাত্রদের ব্যবহার করে ইতিহাস মীমাংসার ক্ষেত্রে কালবিলম্ব ঘটাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে বর্গ লুঙ্গি কাছা মেরে একাত্তরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে জীবনপণ লড়েছিল তাদের ইগনোর করে বা তাদের বিপরীত বলয়ে রেখে অথবা সমাজের সেই শুকতলাকে শত্রু বানিয়ে সামগ্রিকভাবে ইতিহাস মীমাংসিত হতে পারে কি?
দাড়ি-টুপিতে সিম্বলিক মানুষগুলো একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধকে নিজের আর্থ-সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন আকারে নিয়েছিল। আর সে কারণেই মধ্যবিত্তর চেয়ে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও নির্দ্বিধায় জীবন বিপন্ন করে বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক হয়ে উঠেছিল। বক্তৃতাবাজি বা ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা নিম্নবর্গের জন্য সেই রক্ত-উদ্বেলিতকালে বাহুল্যই ছিল মাত্র। কিন্তু আজ যুদ্ধাপরাধের বিচার ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও মানুষের আর্থ-সামাজিক মর্যাদার বিপরীতে রাজনৈতিকভাবে দাঁড়ানো ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নটি সমাজের সেই শুকতলা শ্রেণির কাছে কেন আর একাত্তরের মতো করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে না? একাত্তর সালে যে উদ্বাস্তু-উন্মূল কৃষক মুক্তির প্রশ্নটিকে আত্মমর্যদা ও নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন আকারে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল সর্বাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর বিপরীতে প্রায় নিরস্ত্র ও অপ্রস্তুতভাবেই, আজ সেই কৃষকের সন্তান কেন পিতার স্বপ্নের বিপরীতে হেফাজতের লংমার্চে আগুয়ান? এই প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে আমরা কি পারব আমাদের কালের কল চালিয়ে নিতে? আমাদের জাতিগত, রাষ্ট্রীয় সংহতি স্থাপন কি সম্ভব এই কৃষকবর্গের সন্তানের, নিজের সন্তানের বুক মাড়িয়ে?
আজ হেফাজতে ইসলামের ব্যবহৃত মাদ্রাসাছাত্রটি গতকালই আপনার আমার বাড়িতে মিলাদ মাহফিলে, বাবার কবর জিয়ারতে ব্যবহৃত হয়েছে। তাকে দেয়া দান-খয়রাতেই আমরা পুলসেরাত পারি দিতে চাই। আমাদের ভোগবিলাস আর বিত্তবৈভবের শরীর থেকে চুঁইয়ে পড়া উচ্ছিষ্টভোগই তাদের আহার। আমাদের পুণ্যি অর্জন সামাজিক মর্যাদার বাড়বাড়ন্ত তাদের দরিদ্রতায়। আমাদের পরপারের বেহেস্তখানায় সুমিষ্ট পানির নহর বইবে বলে এপারের মসজিদেই তাদের আশ্রয়। এভাবে আমরা ইহকাল-পরকাল উভয়কালের মালিক; তারা ঠিকাদার, মেহনতি।
বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দগদগে ঘা হয়ে থাকা, বিপণিবিতান আর টিভিবাক্সে সাজানো বৈষম্যে লাঞ্চিত মাদ্রাসাছাত্রের হেফাজতে ধর্মের নামে রাজনৈতিক ঘুঁটিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত আমাদের উঠানে মিলাদ পড়ানোর বাস্তবতায়। নিজের বাড়ির পাশের মসজিদে-মাদ্রাসায় দয়ানুকূল্যে ভিখিরি বানিয়ে পোষা হয় যাকে, সে সুযোগ পেলে আপনার দানদয়ার শরীরে ছুরি বসাতে কার্পণ্য করবে না এই তো স্বাভাবিক। আপনি ভেবেছিলেন ওকে আখেরাত দিয়ে দিনদুনিয়ার শানশওকত দখলে রাখবেন। আপনার বাড়া ভাতে জল ঢেলে দিতে ও যে প্রস্তুত! তাই প্রশ্নটির গোড়ায় হাত না দিয়ে সমাজের এই অসুখের উপশম নেই।
মাদ্রাসাছাত্রের গণতান্ত্রিক শিক্ষার আয়োজন না করে, তার সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে বিপুল অধিকাংশ মানুষকে অবহেলা লাঞ্ছনায় নিমজ্জমান রেখেই ৪২ বছর ধরে ইতিহাস মীমাংসার প্রশ্নটিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঝুলিয়ে রেখেছে। সমাজের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের তাড়নায় বেসামরিক রিজার্ভফোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছে। সময়ে-অসময়ে তাদের ধর্মোন্মাদনা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সামাজিক প্রগতি। বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলমান কৃষক-শ্রমিকের সন্তানের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক বরাদ্দকৃত মাদ্রাসা শিক্ষাকে স্বাধীন বাংলাদেশেও গণতান্ত্রিক শিক্ষায় রূপান্তর না করার পরিণতি আজ হেফাজতে ইসলামের অভ্যন্তরে আত্মঘাতী আপন সন্তান। আর এই সামাজিক আত্মঘাতে সমাজ রাষ্ট্র হয়ে উঠবে ক্ষতবিক্ষত। তাই অতি সত্বর মাদ্রাসা ছাত্রদের বিজ্ঞানমুখি গণতান্ত্রিক সাধারণ শিক্ষার আওয়তায় আনার প্রশ্নটিকে সর্বোতভাবে সামনে আনতে হবে। সমাজের এই বিপুল অধিকাংশ সন্তানদের অপশক্তির দাবার ঘুঁটিতে রূপান্তরের পাঁয়তারা রুখে দিয়ে তার মেধা শ্রম সমাজের অগ্রগতি সাধনে যুক্ত কর হবে। শাহবাগে সমবেত শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম ও হেফাজতে ইসলামের নামের আড়ালে যুদ্ধাপরাধী রক্ষায় ব্যবহৃত কিশোরের মাঝে তৈরি করা বিভাজন রেখা নির্মূল না করে সমাজে কোনো সংহতি স্থাপন হতে পারে না। এই বিভাজন যতদূর প্রসারিত হবে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ততই অন্ধকার গড্ডলিকায় প্রবাহিত হতে থাকবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১১, ২০১৩
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর