ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও ব্রিটেনের এক পুলিশ কর্মকর্তা

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৩
মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও ব্রিটেনের এক পুলিশ কর্মকর্তা

ঢাকা: বাংলাদেশসহ বিশ্বের কোনো কোনো জায়গায় সংবাদ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কেউ কেউ নতুন করে প্রশ্ন তুলেছেন।

দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের পর ফরহাদ মাজহারসহ টক-শো বিশারদরা এ নিয়ে টক চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ এক বিষয় বটে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারটি উচ্চারিত হতেই পারে। কিন্তু স্বাধীনতা মানে মিথ্যাচার তো নয়ই, এমনকি স্বেচ্ছাচারিতাও নয়।

পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন এবং কাবা ঘরের গ্র্যান্ড মুফতির ছবি প্রকাশ করে সাঈদী কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিতে কাবার সামনে মানববন্ধন, এটা শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, কল্পনাপ্রসূত বটে।

সৌদি আরবের জন্য এ ধরনের ঘটনা এমনকি তাদের রাষ্ট্রের আইন-কানুনের সঙ্গে যায় না।

এমনকি যেখানে কাবাঘর প্রদক্ষিণের সময় মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তুলতে বাধা দেয় পুলিশ, সেখানে মানববন্ধন করার মতো সময় কিংবা সুযোগ হয়ে এঠা অস্বাভাবিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত।

মাত্র বিশ দিন আগে মক্কা থেকে ফিরেছি। মুসলমানদের বিজয় ঘোষণার পর কাবা শরীফ সেই সহস্রাধিক বছর আগ থেকেই ২৪ ঘণ্টার একটি ব্যস্ত ও পবিত্রতম জায়গা। লাখ লাখ মানুষ এখন প্রতিমুহূর্তে অবস্থান করেন সেখানে।

আইনতভাবেই সেখানে কোনো সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, এমনকি তাদের সারাদেশেই। সেখানে কাবা ঘরের সামনে তো প্রশ্নই ওঠে না। কাবাঘরের চতুর্দিকে বিশেষত গিলাফ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় দুই মিনিটের দুই রাকাত নামাজ পড়ার জন্যে ধস্তাধস্তি করতে হয়।

সেখানে এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই। যে সময়টুকু থাকবে না অনন্তকাল পর্যন্ত। সেখানে গিলাফ পরিবর্তনের ছবি ছাপিয়ে ভিন্ন উদ্দেশে পত্রিকায় ছাপিয়ে দেওয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নয়, রীতিমত মিথ্যাচার। এমনকি ইসলাম ধর্মের একটা প্রধান কনসেপ্টের সঙ্গে মিথ্যাচার করা।

কিন্তু, ইসলাম নিয়ে এই মিথ্যাচার আমাদের কতিপয় কথিত আলীম-ওলমারা লুফে নেয়। তারা ওইসব জেনেও এর প্রতিবাদ করেন না। প্রকারান্তরে মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ পবিত্র ধর্মকে নিয়ে এখানে তামাশা করেছেন। অথচ আমাদের তথাকথিত আলেমরা এটাকে সাঈদী কিংবা নিজামী-মুজাহিদদের ইসলামের সৈনিক হিসেবে চালিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে ফায়দা নিতে চেয়েছেন, একটা বড় ধরনের মিথ্যাচার করেছেন।

আমাদের হেফাজতে ইসলামেরা এ নিয়ে কোনো কথাও বলেনি। বরং তারা মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন।

ব্লগার নিয়ে বলতে গেলে প্রথম শুরু করেছিল দৈনিক আমার দেশ। ব্লগাররা ‘নাস্তিক’ এবং এরা মূলত গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরেই বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করছে। আমার দেশ সার্থক।

দেশে ছিলাম তিন সপ্তাহের মতো। একটা নিউজ পেপার এজন্সিতে মাঝে-মধ্যে বসতাম। আড্ডা দিতাম বিকেলে একসময়ের সতীর্থদের সঙ্গে।

দেখেছি অন্যান্য পত্রিকার কাটতি। প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, সমকাল প্রভৃতি পত্রিকার পাঠকদের পাশাপাশি কীভাবেই  মানুষ এসে দৈনিক আমার দেশ খুঁজতো! খুঁজেই প্রথমত যে কমেন্টগুলো করতো, দেশ নাস্তিকদের হাতে।

আস্তিক-নাস্তিক শব্দগুলোকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মাহমুদুর রহমান তার  দৈনিক আমার দেশ-এর মধ্য দিয়ে।

একসময় বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দিনকাল কিংবা যায় যায় যায় দিন (মালিকানা পরিবর্তনের আগে) যা পারে নি, এমনকি পাঠকদের কাছাকাছিও যেতে পারে নি, সেই মাহমুদুর রহমান শুধু যায় যায় দিন কিংবা দিনকাল-ই নয়, এমনকি জামায়াত-শিবিরের দৈনিক সংগ্রাম-এর মতো পত্রিকার মুখপাত্র হয়ে একইসঙ্গে কাজ করেছে।

মিথ্যাচার-প্রোপাগাণ্ডা, ইসলাম নিয়ে বাজে ধরনের সুড়সুড়ি, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মাহমুদুর রহমানের আমার দেশ মূলত ইসলাম এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই কাজ করছে। এখানে সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকতার বাকস্বাধীনতার বিষয়টি মিথ্যাচারেই পর্যবসিত হয়েছে।

অথচ রাষ্ট্র কোনো এক অদৃশ্য কারণে কিছুই যেন করতে পারেনি এতদিন। দিনের পর দিন এই কাগজটি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জনগণকে নিয়ে গেছে বিভ্রান্তির অতলান্তে। অথচ কিছুই যেন হয় নি মাহমুদুর রহমানের।

মাহমুদুর রহমানকে এমন এক সময় আটক করলো সরকার, যখন গ্রেফতার করা হচ্ছে বিএনপি নেতাদের। বিএনপি নেতারা এখন যেন দাঁড়াতে পারছেন না। যিনিই মুখপাত্র হিসেবে আসছেন, তাকেই ধরা হচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতারা আটক, জুনিয়ররাও যেন সামনে আসতে ভয় পাচ্ছেন।

সেটা সরকারের কোন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, তা প্রশ্নবোধক থেকেই যাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিকে সবচেয়ে ভয়াবহ কিংবা সাম্প্রদায়িকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে এখন যে হেফাজতি গ্রুপ, তাদের খুব একটা কিছু করতে পারছে না।

কারণ বাংলাদেশে এখন বিএনপি সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি আর সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে মাঠে নামা রাজনীতির ভয়ংকর গ্রুপটি হলো হেফাজতি কিংবা জামাতি গ্রুপ; যা তারা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে পুলিশ হত্যা করে, রাজনীতিতে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে, আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে।

অন্যদিকে, এ সময়ে মাহমুদুর রহমানকে আটক করে কিংবা রিমান্ডে নিয়ে মাহমুদুর রহমানকে মূলত বিএনপি নেতাদের সঙ্গেই মিলিয়ে দিলো সরকার। এতে করে সরকার অবশ্য একসঙ্গে দুটো ঢিল ছুড়লো। পত্রিকা সম্পাদকের যে গুরুত্ব, সেই গুরুত্ব থেকে তাকে সরিয়ে এনে রাজনীতির পতাকাবাহী হিসেবেই দেখাতে সক্ষম হলো। পাশাপাশি মাহমুদুর রহমানকে বিএনপি কিংবা হেফাজতিদের হেফাজতকারী হিসেবেও জনগণের কাছে তুলে ধরার একটা সুযোগ ব্যবহার করে।
 
বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও তাৎক্ষণিক বিবৃতি দিয়েও এটা আরও পাকাপোক্ত করলেন। যদিও আমার দেশ-এর মাহমুদুর রহমানকে আটকের কাজটি সরকার আরও আগে করলে দেশ ৬ এপ্রিল সাম্প্রদায়িকতার এই হেফাজতি মহপ্লাবন থেকে রক্ষা পেতো।

মাহমুদুর রহমান এখনও বলছেন তিনি কোনো অন্যায় করেননি বিচারকের স্কাইপে সংলাপ প্রকাশ করে। এটা তিনি মাত্র ব্রিটেনের ইকোনমিষ্ট থেকে অনুবাদ করেছেন। সরকার এ নিয়ে হয়ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

শুধুমাত্র খবরের জন্য হ্যাকিং অনৈতিক। এই অনৈতিকতার কারণেই ১৬৮ বছরের পুরনো ব্রিটেনের নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড তার প্রকাশনা বন্ধ করেছে। গচ্চা দিয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড। সুতরাং মাহমুদুর রহমান যা করেছেন, তা ইকোনমিস্টের অনৈতিকতারই ধারাবাহিকতা।

লেখাটা শেষ করতে চাই দুদিন আগে ব্রিটেনের একজন পুলিশ কর্মকর্তার পদত্যাগ নিয়ে। পুলিশ কর্মকর্তা পদত্যাগ না করলেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হতো। কারণ, তিনি সম্প্রতি প্রয়াত  ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্ক টুইটারে নেতিবাচক মন্তব্য প্রকাশ করেছেন।

থ্যাচারের নেতৃত্ব নিয়ে জনগণের অসংখ্য প্রশ্ন আছে; কিন্তু ক্যামেরন কিংবা তার সরকার মনে করে লেডি থ্যাচার শুধু তার পার্টিকেই নয়, গোটা ব্রিটেনকেই এক সময় তিনি বাঁচিয়েছিলেন এক বড় ধরনের মন্দা থেকে। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা জেরেমি স্কট লেডি থ্যাচারের শাসনামলকে কিংবা তাকে ভালো চোখে দেখেননি। থ্যাচারের শেষকৃত্যের ৮ মিলিয়ন পাউন্ড খরচের সরকারের পরিকল্পনাকেও হয়ত তার ভালো লাগে নি।

তাই হয়ত তার ক্ষোভের বহিপ্রকাশ স্কট ঘটিয়েছেন- থ্যাচারের মৃত্যু হলো ‘পেইনফুল অ্যান্ড ডিগ্রেইডিং’ (যন্ত্রণাদায়ক এবং নিম্নমানের)।

পাশাপশি তিনি উল্লেখ করেন, ৮৭ বছর পর্যন্ত এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা (এইট্টি সেভেন ইয়ার্স টু লেইট)  লেডি থ্যাচারের জন্য অনেক বেশি।   তার এ প্রতিক্রিয়াটি টুইটারের কারণেই একটা দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ছোট করেছে। বলতে গেলে রাষ্ট্রের জন্যে এটা অমর্যাদাকর।

পুলিশ কর্মকর্তা হয়ত আইনের চোখে খুব বড় কোনো অপরাধ করেননি। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগে মৃত একজন রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে করা এই উক্তি দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনে নি।

মাহমুদুর রহমান এ দেশের জন্য সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন তার পত্রিকা দিয়ে। তা কি অনৈতিক কিংবা অপরাধ, ভবিষ্যৎই হয়ত বলে দেবে আমাদের।

ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্য অভিবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ইমেইল: faruk.joshi@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।