ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শেয়ার ব্যবসায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা

আবুল বাসার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৩
শেয়ার ব্যবসায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা

একটি খুব অজনপ্রিয় লেখা লিখতে বসেছি। অনেকেরই আবেগ আহত হবে হয়তো এ লেখায়।

তাদের প্রতি আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

গত বছর শেয়ার মার্কেটে ক্রমাগত দরপতন ফলে বাংলাদেশে কত সংখ্যক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী গবেষণা হয়নি। কিন্তু তারপরও মিডিয়া, কিছু কিছু বোকা কিন্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং মতলবি রাজনীতিবিদ মিলে যে সংখ্যাটিকে ইতিমধ্যে খুব জনপ্রিয় করে তুলেছেন, তা হলো ৩৩ (তেত্রিশ) লাখ। রাজনীতির মতলবি আবেগ দিয়ে বলা হচ্ছে এই ৩৩ লাখ পরিবারের ‘জীবন আছে, প্রাণ নেই। মুখ আছে, ভাষা নেই’। এই সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলা এক কৌশলী অতিরঞ্জন। সত্যের খাতিরে এই অতিরঞ্জনের অর্থনৈতিক ব্যবচ্ছেদ অতি প্রয়োজন।

প্রথমেই পাটি গণিতের কিছু সমীকরণ এবং অর্থনৈতিক কিছু সম্পর্কের উপর আলোকপাত করা যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে শহুরে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৬১ লাখ ৭০ হাজার। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকারী ৩৩ লাখ পরিবার এদেরই অংশ। যদি সত্যি সত্যি এই ৩৩ লাখ পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে থাকে, তার অর্থ দাঁড়ায় দেশের মোট শহুরে জনগোষ্ঠীর ৫৩ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিকভাবে চরম পর্যুদস্ত। একটু ভাবুন তো অর্থনৈতিক গেঁড়াকলে হঠাৎ করে বাংলাদেশের শহুরে বাবুদের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫৩ জনের জীবন থেকে ‘প্রাণ’ চলে গেছে, মুখ থেকে ভাষা চলে গেছে, অথচ পণ্যের বাজারে তার কোনো প্রভাব নেই। বিষয়টি কি স্বাভাবিক?

কিছু কিছু পণ্যের, যেমন টেলিভিশন, ফ্রিজ, মূল ক্রেতা কিন্ত শহুরে বাবুরাই। সত্যি সত্যি যদি এ বাবুদের অর্ধেকেরও বেশি অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা এবং মূল্য কমে যাওয়ার কথা। আদতে সেটা হয়নি এবং হবার কোনো লক্ষণও নেই, যা ৩৩ লাখ পরিবার পথে বসে যাবার আবেগি বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পাটিগণিত এবং অর্থনীতির মধ্যে কোথাও একটা অমিল হচ্ছে।
    
সেই অমিলের দায়টা কার ঘাড়ে চাপাবেন সেটা বুঝতে হলে শেয়ার ব্যবসার প্রাসঙ্গিক একটা জিনিস জানতে হবে। শেয়ার মার্কেটে ব্যবসা করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের একাউন্ট খুলতে হয়, যাকে সংক্ষেপে বিও একাউন্ট বলে। বাংলাদেশে মোট বিও একাউন্টের সংখ্যা প্রায় ৩৩ লাখ। আর তার উপর ভিত্তি করেই বলা হচ্ছে শেয়ার মার্কেটের দরপতনে ৩৩ লাখ পরিবার অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। দুইটি খুব প্রাসঙ্গিক জিনিস এ ক্ষেত্রে খেয়াল করা হয়নি।

প্রথমত, একজন শেয়ার ব্যবসায়ীর কেবলমাত্র একটি বিও একাউন্টই থাকে না। অনেকের সাথে কথা বলে দেখা গিয়েছে যে একজন শেয়ার ব্যবসায়ীর গড়ে তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট আছে। একটি তার নিজের নামে, আরেকটি তার বিশ্বস্ত কারো নামে এবং আরেকটি তাদের দুইজনের নামে। কিন্ত সব অ্যাকাউন্ট সে নিজেই পরিচালনা করে। তার অর্থ দাঁড়ায় দেশে ৩৩ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট থাকলেও, শেয়ার মার্কেটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত দেশের প্রায় ১১ লাখ মানুষ। তারা ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে এসেছে ধরে নিলেও শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ, ৩৩ লাখ নয়। শেয়ারের দামের উঠানামার ফলে তাদের কেউ কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এবার আলোকপাত করা যাক আসলে সম্ভাব্য ১১ লাখ পরিবারের মধ্যে কত সংখ্যক পরিবার আসলেই শেয়ার মার্কেটের দরপতনের যে ক্ষতিকর প্রভাব সেটা এড়াতে পারেননি। একটা কথা শুরুতেই বলে নেয়া দরকার, যখন কোনো পণ্যের বাজার দর কেনা দামের চেয়েও কমে যায়, ব্যবসায়ী তখন সম্ভব হলে সে পণ্যটি তখনই বিক্রি না করে দাম বাড়ার জন্য অপেক্ষা করে। এভাবে তিনি সম্ভাব্য লোকসানকে এড়িয়ে যেতে পারেন। যদি কোনো কারণে এ অপেক্ষাটুকু না করতে পারেন, তা হলেই কেবল তার জন্য লোকসান অনিবার্য। বিষয়টি শেয়ার মার্কেটের ক্ষেত্রেও একই রকম।

তাহলে শেয়ার মার্কেটের দরপতনের ফলে কয়টি পরিবারের ‘জীবন আছে প্রাণ নেই, মুখ আছে ভাষা নেই’ অবস্থা দাঁড়ায়, তা নির্ভর করে শেয়ার ব্যবসায়ীদের মধ্যে কতজনের ক্ষেত্রে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের অন্যতম উৎস ছিল শেয়ার ব্যবসার আয়। শেয়ার মার্কেট মূলত একটা ফটকা কারবারের ব্যবসা। দামের উঠানামাই এ মার্কেটের বৈশিষ্ট্য। দামের এ রকম উঠানামার ফলে উপকৃত হয়, আর সেই উপকারই অন্য কারো জন্য অপকার হয়ে দাঁড়ায়। আবার একই শেয়ার ব্যবসায়ী আজকে উপকৃত হয় এবং আগামীকাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো নিয়ম করেই শেয়ার মার্কেটের এ বৈশিষ্ট্যকে ঠেকানো যাবে না এবং সেটা উচিতও হবে না।

সাধারণত শেয়ার ব্যবসায় একজন ব্যবসায়ী তার সঞ্চয় বিনিয়োগ করে। ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। কিন্ত ব্যতিক্রমী সেই সংখ্যাটা কত, সেই বিষয়ে কোনো অনুসন্ধানী গবেষণা হয়নি। এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, শেয়ারের দরপতনের সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিলে যারা সংঘবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে অন্যের গাড়ি ভাঙচুর করে কিংবা জুতা প্রদর্শন করে, তারা সবাই শেয়ার ব্যবসার মুনাফা দিয়ে তাদের পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করে। এদেশে বিভিন্নজন বিভিন্ন ভাষায় এবং বিভিন্ন মিডিয়া বিভিন্নভাবে এমন একটা ধারণা তৈরি করেছে যেন শেয়ার মার্কেটে যারা ব্যবসা করছেন তারা কখনোই আর্থিক ক্ষতির মুখ দেখা খুব অন্যায্য একটি কাজ। যার ফলে যখনি শেয়ারের দাম কমে, তখনি ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়, ক্রোধ প্রকাশ করে। এমন কি অন্যের সম্পদ বিনষ্ট করে, যা অন্যায়। যেন ব্যবসায় তাদের লোকসানের দায়টা অন্য সবার, কোনভাবেই তার নিজের নয়। কিন্ত যখন মুনাফা হয়, তার সবটুকুই তার পকেটে যায়, অন্য কারো নয়।

আমি যদ্দুর জানি একটি চলমান গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে, শেয়ার ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্তের সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশেরও কম। এরাই হয়তো শেয়ার ব্যবসার মুনাফা দিয়ে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করে। শেয়ারের দাম কমে গেলেও হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর হয়তো তাদের তা বিক্রি করতেই হয়। আসলে শেয়ার ব্যবসা তাদের জন্য একেবারেই সঠিক ব্যবসা নয়। গত বছরের শেয়ার মার্কেটে ক্রমাগত এবং দীর্ঘকালীন দর পতনের কেবল এরাই চরমভাবে ভুক্তভোগী। সংখ্যার হিসাবে এদের পরিমাণ হবে প্রায় লাখ খানেক। এক লাখ পরিবার কম কথা নয় মোটেও, তবে বহুল আলোচিত ৩৩ লাখের তুলনায় অনেক কম বৈকি।

শেয়ার মার্কেটে প্রকৃত লোকসান সম্বন্ধে প্রচলিত একটি ভুল ধারণার উপর আলোকপাত করা যাক। ধরা যাক, গজনফর আলী একটি ১০০ টাকা সমমূল্যের প্রাইমারি শেয়ার কিনেছেন ১২০ টাকা দিয়ে। দুই সপ্তাহ পর তার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০ টাকা। গজনফর আলী কাগজে-কলমে ২০ টাকা মুনাফা অর্জন করে। কিন্ত এ মুনাফা তখনি বাস্তব হবে যদি সে শেয়ারটি বিক্রি করে। ধরা যাক গজনফর আলী শেয়ারটি বিক্রি করেনি। আরো দুই সপ্তাহ পর শেয়ারটির দাম ১৪০ টাকা থেকে কমে ১৩০ টাকায় দাঁড়ায়। গজনফর আলীর হিসাবে সে ১০ টাকা লোকসানের সম্মুখীন, কিন্তু আসলে সে এখনো মুনাফাতেই আছে। মুনাফার পরিমাণ ২০ টাকা থেকে কমে ১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে মাত্র। যতক্ষণ পর্যন্ত শেয়ারটির দাম ১২০ টাকার চেয়ে কম না হয়ে যায় এবং গজনফর আলী তা সে দামে বিক্রি না করে ততক্ষণ প্রকৃত অর্থে গজনফর আলীর কোন আর্থিক ক্ষতি হয়নি।

শেয়ার ব্যবসা করতে গিয়ে যে সব গজনফর আর রমেশ সেনরা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের প্রতি আমারও সহানুভূতি আছে। কিন্ত তাদের কথিত সংখ্যা এবং রাষ্ট্রের পয়সায় তাদের এ ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার যে জনপ্রিয় দাবি, আমি তার সঙ্গে একমত নই। মরহুম চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীন তার কলাম এবং বইয়ে বর্ণনা করে গিয়েছেন কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কিভাবে বাংলার অনেক কৃষক পরিবারে নেমে আসে সীমাহীন দুর্গতি। তাদের কেউ কেউ সেই দুর্গতির ভার সইতে না পেরে বেছে নেন আত্মহননের পথ। সেই অবস্থা এখনো আছে। কিন্ত মোনাজাত উদ্দীনের মতো সাংবাদিক নেই বলেই সেই দুর্ভাগাদের কথা আর মিডিয়ায় আসে না।

রাষ্ট্রের পয়সায় যদি কোন ব্যবসায়ী বা উৎপাদকের ক্ষতি পূরণের কথা আসেই, তাহলে সবার আগে প্রাধান্য পাওয়া উচিত সিরাজগঞ্জের সেই পাটচাষী যে গঞ্জের বাজারে তার অবিক্রিত পাটে আগুন দিয়ে রাত্রে আর বাড়ি না ফিরে চলে যায় না-ফেরার দেশে, অথবা মুন্সীগঞ্জের সেই আলু চাষী যে ন্যায্য দামে তার আলু বিক্রয় করতে না পেরে এক বুক হতাশা নিয়ে অবিক্রিত আলু স্তুপের পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না। শেয়ার ব্যবসায়ীদের আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার চেয়ে ঢের উত্তম কাজ হবে এটি।  

লেখক: পিএইচডি গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বি আই ডি এস)
ই-মেইল: cccg67@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।