প্রত্যহ অনেক দুঃসংবাদের ভিড়ে খুব উদ্দীপনামূলক একটি খবর আজ নজরে এলো। আর তা হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের কলংকিত হত্যাকাণ্ড যা “জেল হত্যা” নামে পরিচিত সেই মামলার আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি আগামী ৩০ এপ্রিল রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন।
একটু পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চার বীর সেনানী এবং জাতীয় নেতা শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে বিশ্বাসঘাতকরা অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বাঙালি জাতির মুক্তির ইতিহাসে এই মহান নেতাদের অবদানের কথা স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আওয়ামী লীগের প্রথম সহসভাপতি, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অন্যতম সহসভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক এবং এএইচএম কামরুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও এএইচএম কামরুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই যখন বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পাকিস্তানের সামরিকজান্তারা গ্রেপ্তার করে, তখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার নীতি ও কৌশল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁরা।
এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সবচাইতে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক সদস্য হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে। তার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় এই চার নেতাকে তার সরকারে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তাঁরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে তাঁদের গ্রেফতার করে ২২ আগস্ট কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমাদের প্ররোচনায় এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাসী মধ্যম সারির জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হত্যাকারীরা শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হয় নি, মহান চার নেতাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
জেল হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এর দু বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর এ হত্যার সাথে জড়িত ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ বিচারকাজ চলার পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মামলাটির রায় ঘোষণা করা হয়। ঐতিহাসিক বহুল প্রতীক্ষিত সেই রায়ে চার নেতা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০ আসামির মধ্যে ১৫ জনের সাজা হয়। এর মধ্যে তিন সাবেক সেনা কর্মকর্তার ফাঁসি এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
অন্যদিকে, মামলার তদন্তে পাওয়া হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মরহুম কেএম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং মেজর (অব.) খায়রুজ্জামানসহ ৫ জনকে খালাস ঘোষণা করা হয।
পরবর্তীতে এ রায় পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযুক্ত হয়। জাতীয় চার নেতার স্বজনরা সাক্ষ্য-প্রমাণের বাইরে গিয়ে দেয়া ওই রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা করে, জেলহত্যা মামলার পুনর্বিচার এবং খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে।
দীর্ঘ সময় ধরে মামলার শুনানি শেষে অবশেষে জানা গেল যে, এই হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষিত হবে এ মাসের শেষ দিনটিতে।
আমরা চাই না ইতিহাসের ঘৃণিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় নিয়ে পুনরায় কোনো অসন্তোষ হোক। আমরা চাই না ন্যায়বিচার পক্ষপাতদুষ্ট হোক। ন্যায়বিচারের অন্তরালে নোংরা রাজনীতির কূটচাল আমরা বুঝি না, আমরা বুঝতেও চাই না।
আমাদের স্বাধীনতা যাঁদের হাত ধরে এসেছে, তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যার সাথে জড়িত সকল চক্রান্তকারীর বিচার হোক। জাতির ইতিহাসের কালো দিবস হিসেবে চিহ্নিত দিনটি ন্যায়বিচারের আলোয় উদ্ভাসিত হোক।
আমরা আলো চাই, অনেক আলো। সেই আলোয় দূর হোক ইতিহাসের যত কালো।
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, কলামিস্ট এবং ব্লগার,
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১৩