বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা সংবাদকর্মীদের ধর্ম হলেও আমরা নিজেরা এখনও বস্তুনিষ্ঠ হতে পারিনি। প্রতিদিন পরোক্ষাভাবে মৃতদেহ ঘেটেও এখনো লাশের গন্ধে অভ্যন্ত হতে পারিনি।
কিংবা সেই সেনা কর্মকর্তা! যিনি চোখের সামনে দেখেন সারি সারি লাশ! চারদিকে আটকে পড়া আহত মানুষের আর্তনাদে, তাদের উদ্ধারে অপারগতা নিয়ে যিনি চোখ লুকানোর চেষ্টা করছেন। তবু বাধ মানছে না চোখের জল, কেঁপে কেঁপে উঠছে ঠোঁট, লাল হয়ে উঠছে নাকের ডগা।
সংবাদকর্মী বা সেনা সদস্যদের মতো আমরা কতিপয় মানুষ অনেকটা নিরাবেগ, অনেকটা কঠোর। তবু তাদের চোখেই যখন বয়ে যায় জলের ধারা তখন সে মুনাফাখোর লোভী মানুষ- (!) গুলো কোন ধাতুতে গড়া!!
একের পর এক ঘটে যায় দুর্ঘটনা। কখনো বাসের নিচে চাপা পড়ে, কখনো লঞ্চ ডুবিতে, কখনো বা কারখানায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে বা ভবনের নিচে চাপা পড়ে মানুষ।
এ কোনটিকে দুর্ঘটনা, আর কোটিকে হত্যাকাণ্ড বলবেন আপনি!!!
আমি বলব এগুলো হত্যাকাণ্ড। পরিকল্পিত না হলেও এগুলোকে হত্যাকাণ্ডই বলব আমি। কেননা বাস চালকের সীমাহীন উদাসীনতায় ঘটে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো। তবে এগুলো কী দুর্ঘটনা! অতিরিক্ত যাত্রী বহনে ডুবে যায় লঞ্চ, আর কারখানায় আগুন লাগলে বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হয় কলাপসিবল গেট। আর সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনাটা তো রয়েছে চোখের সামনেই।
যেখানে একটু সচেতনতা এসব ঘটনা থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারে সেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেওয়াকে আমি কেন দুর্ঘটনা বলব!!!
আর তো আছেন আমাদের প্রশাসন-রাষ্ট্রযন্ত্র। যারা বরাবরই সব বিষযে পারদর্শী! আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একজনকে দায়িত্ব দিলে তিনি অভিজ্ঞ স্বাস্থ্য ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে যান, কাল আবার তাকে রেল মন্ত্রণালয়ে বা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরিত করলে তিনি একজন অভিজ্ঞ স্থপতি। মোট কথা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা সর্ব বিষয়ে পারদর্শী। আর তাই কখনো কোনো ধরনের মন্তব্য করতে তারা দ্বিতীয়বার ভাবেন না। তারা বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন- ভবন ধরে ঝাকুনি দেওয়ার ফলে এ ভবন ধসের ঘটনা ঘটতে পারে। যদি তাই হয় তবে কেন আমরা একে দুর্ঘটনা বলব। ভবনটি ধরে ঝাঁকুনি না দিলেই তো হতো! (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই কথা বলেছেন)
আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা উঁচু বিল্ডিংয়ের এসি রুম থেকে জানালা দিয়ে দেখেন বাইরের পৃথিবীকে। আর তাই বাইরের পৃথিবীটাকে তাদের কাছে এক নির্মল, ধুলা-বালিমুক্ত মনে হয়। রিকশা বা ঠেলাগাড়ি চালক জানেন রোদের তেজ কেমন হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকরা জানেন একটা কাপড় তৈরি করতে কটা সেলাইয়ের জন্য ক’ফোটা ঘাম ঝরাতে হয়।
আমরা হয়ত একদিন-দু’দিন বড়জোড় তিন দিন এ আহত বা মৃত মানুষের জন্য হা-পিত্যেশ করব। যেমন করেছি তাজরীনে আগুনে কয়লা হওয়া মানুষের জন্য, তারপর সব শান্ত। আমরা ফিরে যাব পুরোনো ঠিকানায়। আবার ছুটবো নতুন কোনো সংবাদের সন্ধানে।
যারা এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তারা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াবে আমাদের চারপাশে। আবার উঠবে ভবন, আবার চলবে কারখানার চাকা।
কিন্তু...যে ব্যক্তিটি তার একটি হাত বা পা হারিয়েছেন, কিংবা যে মানুষটি নিজের চোখের সামনে স্পৃষ্ট হতে দেখেছে প্রিয়জনকে, তিনি কিভাবে ভুলবেন সে দুঃসহ স্মৃতির কথা। কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া যাবে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তাদের। একটি মানুষের জীবনের মূল্য কী মাত্র কয়েক হাজার টাকা! আর মানুষের জীবনের মূল্য কী টাকার হিসেবে পরিমাপ করা যায়!!
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৩