ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পোশাক নিয়ে কিছু কথা

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৩
পোশাক নিয়ে কিছু কথা

সম্প্রতি বারিধারায় এলাকায় লুঙ্গি পরা রিকশাচালকদের চলাচলে বাধা দেওয়া এবং এ সংক্রান্ত আদালতের নেওয়া পদক্ষেপের সংবাদ নিয়ে দারুন হৈচৈ পড়ে গিয়েছে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্লগগুলোতে। রিকশাওয়ালাদের পাশে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন আমাদের আধুনিক তরুণ প্রজন্মের একাংশ।

তারা লুঙ্গি পরে লুঙ্গিমার্চ করেছে বলেও পত্র-পত্রিকাতে ছবিসহ নিউজ দেখেছি।
 
লুঙ্গি আরামদায়ক, সহজেই বায়ু চলাচল উপযোগী, দামও সর্বসাধারণের সাধ্যের মধ্যে এইসব যুক্তি প্রদান করে লুঙ্গিকে পুরুষদের জাতীয় পোশাক করা হোক বলে এমন দাবিও উঠেছে আজকাল।
 
প্রশ্ন হলো পুরুষদের কাছে লুঙ্গি যতই আরামদায়ক পোশাক বলে দাবি করা হোক না কেন, তা কি সর্বক্ষেত্রে একটি শালীন পোশাক বলে গণ্য হবে? যতই বায়ু চলাচলযোগ্য বলা হোক না কেন, তা কি সকল পেশা বা সকল ধরনের আবহাওয়ার জন্য সমীচীন হবে? লুঙ্গির কম মূল্যের কথা বলা হলেও এর থেকে কম দামে কি বাজার থেকে একটি ফুলপ্যান্ট বা ত্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট কেনা সম্ভব নয়?
 
সংসদে লুঙ্গি পরে যাওয়া নিয়ে কোনো আইনি বাধা নেই বলেও অনেকে যুক্তি প্রদান করছেন। পুরুষশাসিত এই সমাজে চাইলে তো একজন পুরুষ খালি গায়েও বাহিরে বেরুতে পারেন। কেউ তো বাধা দেবার নেই। চাইলে তো একজন সাংসদ বাথরুমে পরা স্যান্ডেল জোড়া পরেও সংসদে যেতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কতটা শোভন? কতটা শালীন?
 
পাতলা ফিনফিনে একটা লুঙ্গি ভিতরে কোনো ধরনের অন্তর্বাস ছাড়া বাহিরে বিভিন্ন ধরনের নারী-পুরুষের সামনে পরা কতটা শালীন বলে বিবেচিত হতে পারে? শুধু নিজেদের আরাম কিংবা ধনী এলাকার কর্তারা আইন করেছে এই জন্যই কি লুঙ্গিকে সর্বক্ষেত্রে পরার জন্য জনমত গড়ে তুলতে হবে? নাকি কর্মক্ষেত্রে লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট পরা যুগের দাবিকেও প্রাধান্য দিতে হবে?

অনেকেই বলছেন যে, আমাদের বাপ-দাদারা লুঙ্গি পরে কাজ করেছেন, কাজেই আমরাও লুঙ্গি পরব। কথা হলো আমাদের বাপ-দাদারা তো অনেক কিছুই করেছেন। অনেক ধরনের পোশাক পড়েছেন। সময়ের প্রয়োজনে আধুনিকতার ছোয়ায় নিজেদের কারণেই কি আমরা অনেক নিয়ম পরিবর্তন করিনি?
 
শাড়ি আমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। আমাদের দাদী-নানীরা ইয়া লম্বা ঘোমটা দিতেন। অনেকেই বাসা থেকে বের হতেন না। কামিজ কিংবা জিন্স-ফতুয়াও তো আমাদের পূর্বপুরুষেরা পরতেন না। ফিরিঙ্গির পোশাক বলে কিংবা পাশ্চাত্যের পোশাক বলে এই তো সেদিনও প্যান্ট-শার্ট পরাকে সমালোচনা করা হতো।
 
এখনো মফস্বল শহর বা অনেক স্থানেই মেয়েদের সর্বক্ষেত্রে আরামদায়ক জিন্স-শার্ট পড়াকে অনেকেই শালীন বলে মনে করে না। তাহলে কি এখন নানী-দাদিদের সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আমাদের নারীদেরকেও সর্বক্ষেত্রে শাড়ি পড়তে হবে?

লুঙ্গি আরামদায়ক আর বাতাস চলাচলে সহযোগী পোশাক বলে তা পরায় বাধা দেয়া যাবে না বলা হলে, এই ভ্যাপসা গরমে তাহলে একজন কর্মজীবী নারী আরামদায়ক পোশাক পরে কেন রাস্তায় বের হতে পারবেন না? নারীও তো তাহলে ম্যাক্সি পরতে পারে, স্লিভলেস কামিজ কিংবা স্কার্ট পড়ে বাইরে চলাফেরা করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে কেন কামুক পুরুষেরা সেই নারীকে ধর্ষণ করে সাফাই গায় যে, তার পোশাকের কারণেই সে ধর্ষিতা হয়েছে!! তবে সেক্ষেত্রে কেন শালীনতার প্রশ্ন আসে?

প্রত্যেকটা পেশার ড্রেসকোড আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা ঘোষিত কিছু ক্ষেত্রে তা অঘোষিত। কোথায় কোন পোশাক পরা যাবে কিংবা যাবে না এটা কিন্তু নির্ভর করে অবস্থা ও পারিপার্শিকতার উপর। অনেক পেশা আছে যেখানে আপনি যতই আরামদায়ক কিংবা ঐতিহ্যের যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করুন না কেন, সেই পেশায় কিন্তু লুঙ্গি নামক পোশাককে আপনি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন না। যেমন পুলিশ বা সামরিক বাহিনীতে চেষ্টা করলেও নীল, গেরুয়া কিংবা আর্মি প্রিন্টের লুঙ্গি চালু করা সম্ভব নয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কি শিক্ষকেরা লুঙ্গি পরে পাঠদান করতে পারবেন কিংবা লুঙ্গিকে আরামদায়ক পোশাক মেনে শিশুদের ক্ষেত্রে কি স্কুল ড্রেস লুঙ্গি করা যেতে পারে? ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনি কি লুঙ্গি পরে যাবেন? কিংবা কর্পোরেট অফিসে, সভা-সেমিনারে, সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে?

না যতই আরামদায়ক পোশাক হোক না কেন, আপনি কিন্তু তা করবেন না। এমনকি বাসায় কোনো ভদ্রমহিলা বেড়াতে এলেও কিন্তু আপনি লুঙ্গি-স্যান্ডো গেঞ্জি বদলে একটা পাজামা-প্যান্ট ও শার্ট গায়ে চাপিয়ে বাহিরে বের হন।
 
কারণ আপনার শিক্ষা, শালীনতাবোধ আপনাকে লুঙ্গি পরে বাসায় থাকার বোধ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা যেমন ঘুমানোর সময় কিংবা কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে বাসায় এসে স্যুট-টাই পরে থাকি না, ঠিক তেমনি বাহিরে বেরুনোর সময় ঘরের আরামদায়ক পোশাক লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি বদলে বাহিরের কাজে বের হই।

সিএনজি চালকদের ড্রেসকোড কিন্তু তারা খুশি মনেই মেনে নিয়েছে। ঠিক তেমনি রিকশাচালকের যদি কোনো ড্রেসকোড থাকে তবে ক্ষতি কি? লুঙ্গিমার্চ না করে বরং ধনীদের এলাকা বলে পরিচিত বারিধারা এলাকার বাসিন্দাকর্তৃক যদি রিকশাচালককে দুটো করে প্যান্ট দেয়ার দাবি আদায় করা যেত তাহলে তা হত সব থেকে ভালো একটি কর্মসূচি। তাহলে রিকশাচালকেরা খুশি মনেই প্যান্ট পরে রিকশা চালাবে।

সময়ের প্রয়োজনেই পোশাক পরিবর্তন হয়। সেক্ষেত্রে ঘরের আরামদায়ক পোশাকটি ঘরেই থাকুক না, কর্মক্ষেত্রে সকল পেশাজীবী মানুষের জন্য নির্দিষ্ট ড্রেসকোড থাকলে ক্ষতি কি?

zeniaজিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" বিষয়ে এমএস শেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে বাংলাদেশের "খাদ্য নীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।


বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।