ঢাকা: “নুপুর চাই নুপুর। আমার এবার আর কিছু চাই না শুধু একজোড়া নুপুর চাই? এনে দিবা, বলো না আনবা।
এমন আবদার বাঙালি কন্যা শিশু থেকে তরুণীদের চিরায়ত স্বভাব। সচ্ছল ঘরের মা-বাবারা অবশ্য সন্তানের মুখে কথা ফোটার আগেই নুপুর (নুপুল) কিনে দেন। ফ্রগ পরে আলতো পায়ে কণ্যা শিশু ঝুম ঝুম করে ঘুরে বেড়ায়।
কিশোরী কন্যার নুপুর পরার স্বাদ আরেক রকম, নতুন নুপুর জোড়া পায়ে দিয়ে সবাইকে দেখাবে। আর তরুণীর স্বপ্নে ঘিরে থাকে আলতাসমেত নুপুর পরা উচ্ছ্বল উজ্জল ঝর্নধারার মতো হেঁটে বেড়ানো পা।
সাভারের রানা প্লাজার মৃত্যুকূপ সেই স্বপ্নচূড়ার পা থমকে দিয়েছে। কিন্তু খাঁজকাটা নকশা পরা নুপুর পরিহিত নিশ্চল পা টি অন্য সবার রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পা আজ কোথায় আঘাত করেনি?
ল্যাপটপের ডেস্কটপে ছবিটি বড় করে পুরো স্ক্রিনে দিলাম। যতবার দেখি ভাষাহীন হয়ে পড়ি। ওর নাম দিলাম ‘সেলাই দিদিমনি’। এমন সুন্দর পা আমি আগে কখনো দেখিনি। একটি রক্ত চলাচলহীন পা এতো শক্তিশালী হতে পারে! এমন প্রতিবাদী পা হতে পারে! এমন হাহাকার করা নুপুর পরিহিত পা আর কখনো দেখতে চাই না। এ পায়ের আঘাত যেন আমাদের অন্তত মানুষ করে।
চোখ বন্ধ করে আমি সেলাই দিদির পা খানি জড়িয়ে ধরলাম আলতো করে। যেন ওর ঘুম না ভাঙে। বুকের কাছে লম্বালম্বি করে পা খানি চেপে ধরলাম। নিজেকে আর ধরে রাখা গেল না। মনে হলো- কেউ একজন বলছে, জানো ওভারটাইমের টাকা জমিয়ে নুপুর কিনেছি। সুন্দর লাগছে না? আলতা পরার সময় পাইনি।
এমন সুন্দর পা খানি। পায়ের তালুখানি ঠোঁটে চেপে ধরলাম। সে এক অদ্ভূত অনুভূতি। মাঝে মাঝে আমি আমার চার বছরের ঘুমন্ত শিশুটির পায়ের তালুতে চুমো খাই। ও ভীষণ চঞ্চল। জেগে থাকলে এক মুহূর্তও স্থির থাকে না। তাই রাতে ঘুমালে আমি ওকে চুমু খাই। তখন মনে হয় নিসর্গের কাছে আমি। আজ ‘সেলাই দিদিমনি’র পা খানি আমার ঠোঁট স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, আমি যেন কোন দেবশিশুর পা স্পর্শ করছি। আমি যেন সেই দেবশিশুর মা। সারাদিন ইতিউতি করে ঘুরে বেড়ায়। শত ডাকলেও কাছে আসে না। এখন সে ঘুমিয়েছে। কিন্তু ওর মুখ আমি দেখতে পারছি না। কিছু দিয়ে ঢাকা। আড়াল থেকে পা বেরিয়ে আছে। আহা! কি শান্ত। কোটি চুমু তোর পায়ে।
কপালে রাখলাম সেই পা খানি। নুপুরের আংটা আমার নাকের কাছে এসে পড়লো। কিন্তু আমার এমন লাগছে কেন? রক্তচাপ বেড়ে গেছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।
সংবাদকর্মীর দায় আমার মাথায় কুঠারাঘাত করছে। যদি বাসি-পচা পুঁতিগন্ধময় এই রাজনৈতিক সংবাদের পেছনে না ছুটে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নিয়ে কাজ করতাম, তাহলে হয়তো এমনটা ঘটত না। যদি মঙ্গলবারের হরতালে কে কয়টি বড় মিছিল বের করেছে, বিরোধী দল আর সরকারি দলের মধ্যে আসলে কে জয়ী হবে- সেই সংবাদটাকে বড় করে না দেখে খুঁজতাম অন্য কিছু। যদি কোন একটি জাতীয় দৈনিকে বা টিভি চ্যানেলে এই সংবাদটি পরিবেশন করতে পারতাম-‘বিজিএমইএ ও শিল্প পুলিশ সাভারের রানা প্লাজাকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে’, তাহলেও হয়তো এতোপ্রাণ যেতো না। এমন গগনবিদারী আর্তনাদ শুনতে হতো না। আমাদের ক্ষমা করো সেলাই দিদিমনি। আমাদের ক্ষমা করো। আমাদের মানুষ করো।
লেখক: কৃষক ও সাংবাদিক, usweety75@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৩
জেডএম/এআর