ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পোশাক শিল্পকে রক্ষা করুন

মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৪ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৩
পোশাক শিল্পকে রক্ষা করুন

বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে নেতৃস্থানীয় পোশাক নির্মাতা দেশ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চার মিলিয়ন টেক্সটাইল শ্রমিক কর্মরত রয়েছে যারা সুইডিশ কোম্পানি H&M সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কাপড় সেলাই করে আসছে।

ইউরোপ ও আমেরিকা কাপড় শিল্পে বাংলাদেশের একচেটিয়া বাজার বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক কনসাল্টিং কোম্পানি Mckinsey বাংলাদেশ বিশ্বের পোশাক এবং টেক্সটাইল শিল্পে নেতৃস্থানীয় নির্মাতা হিসাবে এখন চীনকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
 
অন্যদিকে এসকল টেক্সটাইল শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি দেওয়া হয় মাত্র ৩০০০ টাকা। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন মজুরি দেওয়া হয় বাংলাদেশে। যদিও কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি নিজে থেকেই স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করতে পারেন তবুও সরকার থেকে পোশাক শিল্পে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে ৩০০০ টাকা মাত্র। এছাড়া কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ, দৈনন্দিন কাজের সময়সীমা, ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি ও শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি কখনই গুরুত্বসহকারে দেখা হয়নি।
 
সুইডিশ H & M-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কার্ল জোহান পারসন গত বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এক সাক্ষাতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। H & M ছাড়াও আরো কয়েকটি সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান ও ফিনিশ কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে তৈরি কাপড় আমদানি করে থাকে। এখন পর্যন্ত পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি ঘটেছে বলে বলা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। অন্যদিকে Labour behind the label প্রতিনিধি স্যাম মাহের বলেন, H & M-এর বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ এটিই প্রথমবার নয়। এর আগেও তারা কথা বলেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির দাবি পূরণ করা হয়নি। তিনি বলেন গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিকেরা শ্রমিকদের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে যত কম সম্ভব ততটুকুই বেতন দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে H&M চেয়ারম্যান স্টেফান পারসনকে বিশ্বের অষ্টম ধনী ব্যক্তি হিসেবে গণনা করা হয়ে থাকে।
 
অন্যদিকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অশান্তি কাপড় শিল্পের জন্য এক বিরাট বাধার সৃষ্টি করছে। বিরোধী দলের ডাকা ঘন ঘন হরতাল আর ধর্মঘট পোশাক ক্রয়কারী কোম্পানিগুলোকে এখন নুতন করে ভাবিয়ে তুলেছে। শ্রীলংকা আর পাকিস্তানের অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য যারা একদিন বাংলাদেশের প্রতি উত্সাহিত হয়েছিল তারা হয়তো এখন নুতন করে চিন্তা করবে। পশ্চিমা মিডিয়ায় যদিও বলছে বাংলাদেশে টেক্সটাইল শিল্প হওয়াতে অনেক নারীর চাকরি পাওয়ার সুযোগ হয়েছে যা একটি রক্ষণশীল মুসলিম দেশের জন্য ভালো পদক্ষেপ। এই শিল্পে বাংলাদেশে কয়েক মিলিয়ন মহিলা শ্রমিকের কাজের সন্ধান হয়েছে বলেও মতামত পোষণ করা হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়ার মতে এসকল মহিলারা নিজস্ব অর্থ উপার্জন করার কারণে পরিবারের মধ্যে তারা ভালো অবস্থানে আছে। সম্প্রতি একটি সুইডিশ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে কথাটি বলেছেন বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী নাজমা আখতার।
 
অনেকদিন থেকেই দেশের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। কিন্তু সরকার ও রাজনীতিবিদরা বিষয়টিকে কখনই গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে করা হয়েছে রাজনীতি। সাভারে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনা সারা বিশ্বকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শোষিত শ্রমিকদের পরিশ্রমে তৈরি করা এসকল পোশাক বর্জনের জন্যও আহবান জানানো হয়েছে কিছু কিছু দেশে। অন্যদিকে এখনো পশ্চিমা মিডিয়া এই শিল্পকে রক্ষা করার পক্ষে মতামত দিয়ে আসছে। মিলিয়ন মিলিয়ন মহিলা শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে এখনোও অনেক দেশই চায় এই শিল্প বাংলাদেশে দিন দিন আরো অগ্রগতি লাভ করুক।
 
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একমত হওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা না হলে এই শিল্প ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে হাত গুটিয়ে নিবে। সম্প্রতি সাভারে ঘটে যাওয়া ঘটনায় শেষ পর্যন্ত সরকারের টনক নড়ছে বলে মনে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকার পোশাক শিল্পের উন্নতির লক্ষে একজন প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করার কথা ঘোষণা করেছেন। আশা করি সরকার শ্রমিকদের মজুরিসহ যাবতীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে দ্রুত কঠোর আইন করার বেবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া কারখানা মালিকদের সাথে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে সরকারের একমত হওয়া জরুরি বলে অনেকে মনে করছেন। সাথে সাথে ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতে একটা পরবর্তন আনারও প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে নুতন ট্রেড ইউনিয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করলে দেশ ও জাতির জন্য  তা হবে পজেটিভ।
 
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন অত্যন্ত দুর্বল বলে আমি মনে করি। সুইডিশ ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির সাথে দীর্ঘদিন সম্পর্কের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ট্রেড ইউনিয়নকে সরিয়ে আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি সম্পর্কে নেতাদের ট্রেনিং দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, তৃতীয়ত দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করা অতন্ত জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে আসছে। যার কারণে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা না করে সংগঠনগুলো তাদের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা করার লক্ষে নানা অজুহাতে হরতাল, ধ্বংসাত্মক কাজ, ধর্মঘট ও গোলযোগ সৃষ্টি করে থাকে। ব্যক্তি স্বার্থের কারণে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে অনেকক্ষেত্রে বিভক্ত হতেও দেখা যায়। বড় বড় রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কের কারণে শ্রমিক নেতারা দল ক্ষমতায় থাকাকালীন অন্যায়ভাবে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে কালো টাকা আয় করছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ ধরে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য নানা অজুহাতে কারখানাগুলোতে সমস্যার সৃষ্টি করা হয়ে থাকে।
 
সকল প্রকার ধ্বংসাত্মক পথ পরিহার করে গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়নকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করে যেতে হবে। এই আন্দোলন হতে হবে সুশৃংখল ও দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের আওতায়। এসময় শিল্প প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করা উচিত হবে না। বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোকে বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে এগুতে হবে। আন্দোলনের ধারায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। জনগণ হরতাল চায় না। জোর করে এভাবে আর জনগনের উপর হরতাল চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। হরতালে দেশ ও জাতির ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হয় না। সকল প্রকার ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ পরিহার করে আন্দোলনকে ভিন্ন পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিরোধী জোটকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে হরতালকে বাধ দিয়ে অল্টারনেটিভ চিন্তা ভাবনা করা উচিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে ট্রেড ইউনিয়নকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পকে বাচিয়ে রাখতে হলে অতি শীঘ্রই এ ব্যপারে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমত হওয়া উচিত।
 
মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। ১৮৮৬ সালের এই দিনে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আমেরিকায় শ্রমিকরা আন্দোলনের সূচনা করে। ১ মে তারা ধর্মঘটের ডাক দেয়। একযোগে দেশের সকল শ্রমিক সেদিন কাজ বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে ৩ মে শিকাগোর হে শহরে শ্রমিকরা এক বিক্ষোভ সভার আয়োজন করে। এই সভায় আমেরিকান সরকার নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে মারা যায় ছয় জন শ্রমিক ও আহত হয় শতাধিক। ঘটনার শেষ এখানেই নয়। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালের ২০ আগস্ট শিকাগোর ঐ সমাবেশের কারণে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলায় সরকার। দুবত্সর পর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সন্মেলনে ১ মে সারা বিশ্বের শ্রমিক সংহতি দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই থেকে প্রতিবত্সর সারা বিশ্বে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।
 
ঐতিহাসিক মে দিবসের এই দিনে বাংলাদেশের কাপড় শিল্প রক্ষাসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। পাবলিক সেক্টরের কাজগুলো প্রাইভেট সেক্টরে ছেড়ে না দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ এবং শ্রমিকদের দৈনন্দিন আট ঘণ্টা কাজের সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে। অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থারও উন্নতি করতে হবে যাতে করে আরো একটি সাভার দুর্ঘটনা ঘটতে না পারে। শুধু তাই নয় কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিকদের অসুস্থ্য ভাতা, মেটারনিটি লিভসহ অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এগিয়ে আসার সঠিক সময় এখন। দেশের পোশাক শিল্পসহ যাবতীয় কলকারখানাকে রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে একত্রিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আর এই একতার ডাকটি আসতে হবে সরকার থেকে।
 
[মহিবুল ইজদানী খান ডাবলু: নির্বাচিত সদস্য, নির্বাহী পরিষদ, সুইডিশ পোস্টাল ট্রেড ইউনিয়ন স্টকহোম সাউথ ব্রাঞ্চ ও নির্বাচিত সহ-সভাপতি সুইডিশ পোস্টাল ট্রেড ইউনিয়ন স্টকহোম অরসটা পোস্ট টার্মিনাল ব্রাঞ্চ। ]

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ০১ মে ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।