ঢাকা, শনিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্রীতদাস যেন পোশাক শিল্পীরা!

আদিল আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৩
ক্রীতদাস যেন পোশাক শিল্পীরা!

সাভারে ইট-পাথরের নিচে চাপা পড়েছেন আমার শত শত ভাই বোনেরা। স্বজন হারানোর কান্না ও আহাজারিতে বাতাস হয়ে উঠেছে ভারি।

তখন সাধারণ মানুষের মতো আমিও হতবাক ও ক্ষুব্ধ । এই কি আমার দেশ?  যাদের পরিশ্রম ও কারিগরি দক্ষতায় এক সময় বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল ঢাকার মসলিন, জামদানি । যাদের কারণে এদেশের তৈরি পোশাক স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের দরবারে। সেই নিপুণ কারিগরদের আজ মারা হচ্ছে ইট পাথরের নিচে চাপা দিয়ে, লোহার ফটকে আটকে আগুনে পুড়িয়ে । এ যেন লাঠিপেটা করে তাড়িয়ে মৃত্যু-কুপে ঠেলে দেওয়া আফ্রিকার ক্রীতদাসদের প্রতি নির্মমতার কথাই মনে করিয়ে দেয় । কি ছিল তাদের অপরাধ? আর্থিক দীনতা আর অসহায়ত্বই কি তাদের অপরাধ?

একটা বিল্ডিংএ ফাটল দেখে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ এবং জেলা পরিষদ প্রকৌশলী সতর্ক করে দেয়ার পরও গার্মেন্টস মালিকরা কেন তাদের বাধ্য করলেন সেখানে ঢুকতে? তাদের এই অপরাধ এবারই প্রথম ঘটেনি। অতীতেও এ রকম ঘটনা বহুবার ঘটেছে সাভারের বাইপাইলের স্পেকট্রাম গার্মেন্টস, তেজগাঁওয়ের ফিনিক্স গার্মেন্টস ও তাজরীন গার্মেন্টেসে । আগুন লাগার পরও লোহার গেট আটকে রেখে হত্যা করা হয়েছে শত শত গার্মেন্টস শ্রমিককে । বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরিতে শ্রম দিয়ে যারা বিশ্ববাসীর পোশাকের যোগান দিচ্ছেন তাদের নিরাপত্তা দেখার কেউ নেই । তাদের স্বার্থে কোন এসোসিয়েশন দাঁড়ায় না, শ্রমিকদের স্বার্থে কথা বলা আমিনুলদের জীবন দিতে হয় । অথচ শুধুই মুনাফালোভী  মালিকদের স্বার্থ দেখার জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ-র মতো এসোসিয়েশন হয়! কারণ তারা কুলীন, তারা  ব্রাহ্মণ। এই কুলীনদের অনেকেই আশির দশকে শহরের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে গার্মেন্টস ব্যবসা করে রাতারাতি বিত্তশালী হয়েছেন । কিন্তু আজ তারা ব্যস্ত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে, রাজনৈতিক দলগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে। আমার এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমার দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখেছি, আমাদের লোকজন নিজ কাজের বেলায় অজ্ঞ কিন্তু অপরের কাজের বেলায় বিশেষজ্ঞ । আজকে বিজিএমইএ-এর নেতাদের দেখে সে কথাটা খুব মনে পড়ছে । তারা তাদের গার্মেন্টস মালিকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন না শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তারা ব্যস্ত সরকার যেন তাদের ব্যবসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে । শত শত লাশের সারি দেখেও একটু সামান্য সহানুভূতি দেখানোর জন্যও পরদিন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। তাদের অফিস ঘেরাও করে কারখানা বন্ধ করতে হয়েছে। বিজিএমইএ নাকি গার্মেন্টস মালিকদের কোনো দোষ খুঁজে পায়নি। শোনা যায়, বিজিএমই নেতারা সরকারের সাথে বোঝাপড়া করে দুজনকে তুলে দেন পুলিশের হাতে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সাথেও নাকি আলাপ হয়েছে তাদের নেতাদের। আর এসব ব্যবসায়ীরাই তো রাজনীতির অর্থের যোগানদাতা।

একে অপরকে দোষারোপ, মানবতাহীন অপরাজনীতি বরাবরই মানুষকে বিভ্রান্ত করে প্রকৃত ঘটনাকে আড়ালে রেখেছে। দোষীদের কখনো শাস্তি পেতে দেখেনি সাধারণ মানুষ। সরকার ব্যস্ত উদ্ধার কাজে তাদের সফলতা প্রচারে, বিরোধীরা ব্যস্ত ভবন মালিকের রাজনৈতিক পরিচয়কে ব্যবহার করে সুবিধা নেয়ায়। এ রকম রাজনৈতিক পরিচয়ে অবৈধ কার্যক্রমে যেমন যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগকে দেখেছি তেমনি ছাত্রদল, যুবদল বা বিএনপির বেলায়ও একই চিত্র দেখেছি। এটাই আমাদের বর্তমান অপরাজনীতির বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এখন আমরা রানার সাথে কঠোর শাস্তি দেখতে চাই সংশ্লিষ্ট গার্মেন্ট মালিকদেরও।

আমাদের জাতীয় আয়ের প্রধান তিনটি উৎস-- কৃষি, রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি । জাতীয় আয়ের আনুমানিক ২০ ভাগ আসে কৃষি থেকে । কৃষি নির্ভর এই দেশের  কৃষক মানেই আমার গ্রামের সহজ সরল নিরহংকার চাষী যারা হাড় ভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে খাদ্যের যোগান দিচ্ছেন দেশের ১৬ কোটি মানুষের। জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ লাখ লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন, যাদের অধিকাংশই  শ্রমনির্ভর পেশায় নিয়োজিত। তাদেরই পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের একটি অন্যতম প্রধান উৎস। ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রবাসীদের দ্বারা যে বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে  তা আমাদের মোট জাতীয় আয়ের প্রায় ১৪ শতাংশের সমপরিমাণ। আর বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৭৫ ভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প অর্থাৎ গার্মেন্টস থেকে । এদেশে রফতানি কথাটার প্রায় সমার্থক শব্দটাই হচ্ছে এদেশের গার্মেন্টস। আর গার্মেন্টস কথাটার সাথে যে দৃশ্যটা চোখে ভেসে ওঠে তা হলো গ্রাম থেকে আসা অশিক্ষিত, দরিদ্র অসংখ্য তরুণ-তরুণীর ভোর বেলায় সাদামাটা পোশাকে দল বেঁধে টিফিন ক্যারিয়ার হাতে কারখানায় ছুটে চলা।

এদেশের জাতীয় আয়ের প্রধান তিনটা উৎসেরই চালিকা শক্তি হচ্ছে আমাদের স্বল্প শিক্ষিত গ্রামের সাধারণ মানুষ । অর্থাৎ গ্রামের বিশাল একটা অশিক্ষিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠির নারী-পুরুষরাই দেশের মোট আয়ের প্রধান যোগানদাতা । অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বিশাল জনগোষ্ঠি এদেশে সবচেয়ে অবহেলিত। প্রতি বছর আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট হয় বিভিন্ন খাতে। কিন্তু সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না বাজেটের। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে চলে যায় অনেকে। মন্ত্রী মহোদয়রা এসব ব্যাপারে তেমন কিছুই ভাবেন না। অথচ জনবহুল এই নগরীতে কোন দুর্ঘটনায় উদ্ধার কাজের জন্য নেই কোন যন্ত্রপাতি । লঞ্জডুবি, অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধসের মতো কোন দুর্ঘটনার পর দ্রুত মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত নই আমরা। এমনকি দক্ষ লোকবলও আমাদের নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় আছে, ২০১২ তে প্রণীত হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন। কিন্তু তৈরি  হয়নি আধুনিক সরঞ্জাম সমৃদ্ধ একটি দক্ষ উদ্ধারকারী বাহিনী। মানুষের নাড়াচাড়া, টানা হ্যাঁচরা ছাড়াও প্রাকৃতিক ও অন্যান্য কারণেও অনেক রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় ভবন ধসের ঘটনা বেড়েই চলছে। এছাড়া ঢাকা, ভূমিকম্পে ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। তাই দুর্যোগ-দুর্ঘটনা মোকাবেলার প্রস্তুতির বিষয়টি সরকারের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিৎ। এরকম দুর্ঘটনায় আর যেন কোন আলতাফকে বাঁচার জন্য আর্তনাদ করতে করতে চলে যেতে না হয়।

১ মে মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবি মানুষের সংগ্রাম আর সংহতির দিন। শ্রমিকের মর্যাদা আর অধিকার বাস্তবায়নের চেতনায় জাগ্রত হওয়ার দিন । এবারের মহান মে দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হোক শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি প্রতিষ্ঠা।

বাংলাদেশ সময়: ০৩০১ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।