ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব কি কেবল শেখ হাসিনার একার?

মাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৯ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৩
গণতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব কি কেবল শেখ হাসিনার একার?

বিগত কয়েকদিন যাবত দেশে এক নতুন হাওয়া বইছে। সন্দেহ নেই হাওয়াটি ইতিবাচক।

বহু নেতিবাচক ঘটনার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত এগুতে হচ্ছে, এর ভেতর সামান্য ইতিবাচক ইশারাও মানুষকে আশাবাদী করে তোলার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বিরোধী দলী নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে হরতাল প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেন এবং বেগম জিযা যখন তা গ্রহণ করলেন এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী তাকে পাল্টা ধন্যবাদ জানালেন তখন এদেশের মানুষ অনেকদিন পরে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পেরেছে। যদিও উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে এসব খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, সেখানে সরকারি দল ও বিরোধী দল দু’পক্ষই দেশের কথা ভাবে, জাতীয় স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দেয় এবং এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছুতে না পারলে জনগণের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে, যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে গিয়ে পড়ে। কিন্তু এদেশে এরকম কোনো ঘটনা ঘটে না, এদেশে “স্বাভাবিক” প্রক্রিয়াকে “অস্বাভাবিক” বানিয়ে জনগণকে জিম্মি করে জ্বালাও-পোড়াও-নির্যাতন শেষে, অনেক হত্যাকাণ্ডের পরে দু’পক্ষ ইঙ্গিতের ভাষায় কথা বলেন আর এতেই জনগণকে গদগদ থাকতে হয় - কারণ, এছাড়া জনগণের আর কোনো উপায় নেই।

আমরা একটু পেছনে তাকালেই দেখতে পাই যে, প্রায় আড়াই বছরের একটি অনির্বাচিত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেষে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বরাবরের মতো এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করার সমস্ত কৃতিত্বই আওয়ামী লীগের তথা শেখ হাসিনার। বিএনপি তথা বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার এই কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে দিতেই হবে। অনেকেই হয়তো এতে দলীয় রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন কিন্তু একটু পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন, এটা কতখানি সত্য। যা হোক নির্বাচন হলো, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলো, মাত্র এক মাসের মাথায় বিডিআর বিদ্রোহ। একটি নির্বাচিত সরকারের জন্য এই বিদ্রোহের ঘটনা ছিল ভয়ংকর একটি ঘটনা, একই সঙ্গে তা বাংলাদেশের শিশু গণতন্ত্রকে বলতে গেলে “কুঁজো” করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেই সময় সরকারের অনেক কেষ্টবিষ্টুই সরকার কতোদিন টেকে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেন। তাদের ধারণাকে উড়িয়ে দেয়া সম্ভব ছিল না। সরকার এরপর আসলে আর খুব বেশি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বরং এই সুযোগে সরকারের ভেতরে ও বাইরে যে সব চক্র সরকার-বিরোধী হিসেবে কাজ শুরু করেছিল তারা স্বরাজ পেয়ে গিয়েছিল। এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সরকারের ভুলত্রুটিসমূহ। বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রীদের অনেকেরই বালখিল্য ও সরকার-বিরোধী ভূমিকা জনগণকে চরম হতাশ করেছে। এর পরপরই শুরু হয়েছিল বিরোধী দলের বিরোধীতার নামে দেশের অগ্রগতি থামিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র।

যে কোনো দেশে দুটি প্রধান বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক বৈরিতা স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিকভাবে বৈধ। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নীতিগত ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কেবল। আগেই উল্লেখ করেছি যে, জাতীয় স্বার্থে  দু’পক্ষের বিরোধিতা আসলে দেশের ক্ষতিরই কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন জেনারেল জিয়া (বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা, বিবৃতি, আলোচনা ও সংবাদ মাধ্যমে এমন অভিযোগে এসেছে) এবং এই হত্যাকাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তার দল বিএনপি। ইতিহাস আসলে খুব পুরোনো নয়, তাই এর পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নেই খুব বেশি, কিন্তু যাদের নিয়ে তিনি এই দলটি গঠন করেন তারা আর কেউ নয়, চিহ্নিত দেশ-বিরোধী এবং পরবর্তীতে তারা প্রগতি-বিরোধী হিসেবেও চিহ্নিত হন; এমনকি এদের মধ্যে দুর্নীতির দায়গ্রস্তও বটে। জেলহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদগণ গিয়েও যোগ দেন বিএনপিতেই। আবার এই বিএনপি আমলেই ঘটে ২১শে আগস্টের মতো ভয়ংকর ঘটনা। ১৯৯১ সালের সরকারের কথা বাদ দিই। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কথা যদি বলি তাহলে আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে এই ক’বছরে আওয়ামী লীগের বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যার কথা। দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডকে না হয় না ধরি কিন্তু এই চিহ্নিত নেতাদের হত্যাকাণ্ডকে কে কিভাবে দেখেন আমি জানি না, কিন্তু দুটি দলের ভেতরে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এই হত্যাকাণ্ড কোনোদিনই ইতিবাচক সূচক হবে না, ২১শে আগস্ট তো আসলে কফিনে শেষ পেরেক। তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে, জাল ভোটারলিস্ট দিয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার যে প্রক্রিয়া সেই সরকার শুরু করেছিল তার পরিণতিতে তো বেগম জিয়াকেও জেলে যেতে হলো এবং তার পুত্রদের হতে হলো দেশছাড়া। দেশের গণতন্ত্র এর চেয়ে বড় কোনো দুঃসময় পার করেছে কি না তা এই নিবন্ধের পাঠকমাত্রেরই বোধগম্য বলে বিশ্বাস করি।

যাহোক, প্রশ্ন হলো, দেশে গণতন্ত্রের দুঃসময়ে অন্য কাউকে কেন খুঁজে পাওয়া যায় না? কিংবা শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগকেই কেন গণতন্ত্র রক্ষায় ত্রাতার ভূমিকাটি বারবারই গ্রহণ করতে হয়? দেখুন, আমরা আমাদের ব্যক্তি-বিরোধিতার চশমাটি খুলে রেখে যদি দেখার চেষ্টা করি তাহলে একটি সত্য এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই মুহূর্তে আমাদের গণতন্ত্র এবং জাতীয় অগ্রগতি আসলে বিপন্ন। আসুন খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কারা এই বিপন্নতায় ভূমিকা পালন করছে? একথায় আমরা যদি এই শত্রুপক্ষকে চিহ্নিত করতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাদের ফিরে যেতে হয় একাত্তরে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তাদের কাছে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, প্রতিটি জাতির মুক্তিযুদ্ধেই একটি পক্ষ এর বিরোধিতায় নামে। কিন্তু সফল বিপ্লব শেষে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অথবা সমাজে মিশে গিয়ে দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। মানুষ তাদের ভুলে যায় কারণ তারা সংখ্যালঘু ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাদের মাত্র ৫ বছরের মাথায় ফিরিয়ে এনে দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তাদের অতীত ভুলে এদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আস্থা স্থাপন করে এদেশের উন্নতি-অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার কথা ছিল। কিন্তু তাও আমরা দেখিনি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে রগ কাটার রাজনীতি থেকে শুরু করে জাতীয় পতাকার অবমাননা এবং যা কিছু বাঙালির, তার বিরুদ্ধেই ওদেরকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে দেখা গেছে। লোক দেখানো দেশপ্রেম বা সরকারের অংশ হিসেবে বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান দেখানোর চেষ্টা করলেও আস্তিনের তলায় যে তাদের দেশ-বিরোধী ছুরি ছিল তা কিন্তু তারা লুকিয়ে রাখতে পারেনি। মজার ব্যাপার হলো তাদের এই দেশ-বিরোধী, স্বাধীনতা-বিরোধী এবং গণতন্ত্র-বিরোধী কর্মকাণ্ডে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছে বেগম জিয়ার বিএনপি, যার সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের ধ্বংসযজ্ঞে বিএনপির সমর্থন ও একত্রে কাজ করা। আবারও বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনী ঐক্য দেশ ও স্বাধীনতা-বিরোধীদের বাঁচানোর ষড়যন্ত্রে গিয়ে ঠাঁই করে নিয়েছে।

কিন্তু এখনকার যে পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে দেশে হেফাজত নামে নতুন যে উগ্রবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাদের প্রচলিত আইন দিয়েই যদি থামানো না যায় তাহলে আগামী নির্বাচন তো দূরের কথা দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে যাবে। আজকে বিএনপি হয়তো ধরতেই পারছে না যে, হেফাজতের রাজনীতি তাদেরকে কীভাবে আঘাত হানবে শেষ পর্যন্ত, তারা আগ বাড়িয়ে গিয়ে তাদের পানি-বিরিয়ানি খাইয়েছে, একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং এখনও পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে স্বপ্নে তারা বুঁদ হয়ে আছে অচিরেই সে স্বপ্ন ভাঙতে বাধ্য হবে তাদের। মজার ব্যাপার হলো, হেফাজতের ১৩ দফার ভয়াবহতা বিএনপি নেতা বেগম জিয়াকে কোনো ভাবেই স্পর্শ করেনি একথা আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু তারপরও তিনি আশ্চর্যজনকভাবে নীরব এ ব্যাপারে। এখানে সরকারের ভূমিকা প্রথমে আমরা “আপসকামী” দেখলেও ক্রমশ সরকারের বোধোদয় এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিয়ে এই ধর্মভিত্তিক উন্মাদনার সরাসরি বিরোধিতা ও সর্বশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে ১৩-দফার দফাওয়ারি বিশ্লেষণে তা নাকচ করে দেয়াকে আমাদের ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে না দেখে উপায় আছে কি? তার মানে কী দাঁড়ালো? যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জাতীয় অগ্রগতি যখনই হুমকির মুখে পড়ে তখন কেবল শেখ হাসিনাকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায় এবং বাকি সবাই যে যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেন এবং শেখ হাসিনা ও তার দল যখন বিজয়ী হয় তখন ক্ষমতার ভাগ বসাতে এগিয়ে আসতে মুহূর্তকাল সময়ও নষ্ট করেন না। আমি নিশ্চিত যে, হেফাজতের এভাবে ধংসাত্মক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর এই জামায়াতি ষড়যন্ত্রের ভেতরে এক লহমাতেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা তলিয়ে যেতে পারে এবং সেই তলিয়ে যাওয়া থেকে আবার তাকে পথে ফিরিয়ে আনার সামর্থ্য বেগম জিয়া ও তার দলের নেই, সেই সাংগঠনিক বা নেতৃত্বগত কাঠামোই দলটির নেই। আজকে তারা আওয়ামী-বিরোধিতার নামে যাদেরকে একত্রে নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা মূলত বেগম জিয়াকে খোলশ হিসেবে ব্যবহার করছে, এক সময় তাও থাকবে না, সেকথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাই বলে বিএনপিকে সরকারের ভুল-ভ্রান্তির বিরুদ্ধবাদিতা থেকে সরে আসার কথাও বলছি না, সে কাজটিতো তারা বিগত চার বছর ধরেই করার সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু কাজে লাগাতে পারলো কই? এখন যখন গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাই হুমকির মুখোমুখি তখন বেগম জিয়া সরকার-বিরোধিতার নামে আমেরিকার কাছে চিঠি লিখে জিএসপি সুবিধা বাতিল করার জন্য আবেদন জানাচ্ছেন; সরকার সাভারে লাশ গুম করেছে বলে হুঙ্কার ছাড়ছেন। তবে কি আমরা ধরেই নেবো যে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য শেখ হাসিনার সরকারকে দেশি ও বিদেশি, দুই প্রকারের শত্রুর সঙ্গেই লড়তে হবে? বেগম জিয়া ও তার দল কি এই দেশের নন?

প্রশ্ন অনেক তোলা যায় কিন্তু এখন সে সময় নয়, সেটা আমরাও বুঝি। কিন্তু আমাদের মতো আম-জনতা বুঝলে কী হবে? বুঝতে তো হবে যারা এই দেশকে চালাচ্ছেন বা ভবিষ্যতে চালাবেন, তাদেরকে, তাই না? আমরা আনন্দিত হতে পারি দু‍’পক্ষের মাঝে সমাঝোতার ইঙ্গিতে কিন্তু এখন এই ইঙ্গিত যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন “অ্যাকশন”-এর।

ঢাকা, ৪ মে, সোমবার॥ ২০১৩॥

Masuda-bhatti

 

লেখক: সাংবাদিক, গল্পকার, masuda.bhatti@gmail.com

 বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।