বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউজ চ্যানেল সিএনএন’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক চৌকস প্রতিবেদক ক্রিশ্চিয়ান আমানপোরকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যেটিকে নিউজ চ্যানেলটি এক্সুক্লুসিভ বলছে।
সিএনএন প্রতিবেদকের প্রশ্ন করার উদ্ধত ভঙ্গি বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে আলোচনা করা আমার লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মাঝে লুকিয়ে থাকা সত্য-মিথ্যার ধূম্রজাল নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য।
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান ক্রেতা হলো ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা। সস্তা ও দক্ষ শ্রমনির্ভর এই দেশে অতি দ্রুত পোশাকশিল্পের বিস্তার ঘটেছিল। পোশাকশিল্পের মালিকেরা সর্বোচ্চ মুনাফার লোভে শ্রমিকদের ইচ্ছেমত কম মজুরি দিয়ে পোশাক তৈরি করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রয় করে। শ্রমিকের কম মজুরি দেয়ার ব্যাপারটি এদেশে ছিল ওপেন সিক্রেট। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকেরা অনেকবার রাস্তায় নেমে এসেছিল।
সরকার তখন শ্রমিকদের দাবি ঠাণ্ডা করতে লোকদেখানো উদ্যোগ যে নেয়নি তা বললে মিথ্যা বলা হবে। সরকারি উদ্যোগের জবাবে পোশাক শিল্পের মালিকেরা বিলাসবহুল বিজিএমইএ’র শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস থেকে নেমে এসে দামি গাড়িতে চড়ে ব্র্যান্ডের স্যুট পড়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সরকারি পয়সায় মিটিং করেছে। ব্যবসার খুব মন্দা যাচ্ছে এইসব সরকারকে বুঝিয়ে শ্রমিকদের বেতন নামমাত্র বাড়িয়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে তারা প্রতিবার এ সমস্যা পাশ কাটিয়ে গেছে।
আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা তাদের বেতন বাড়ানো নিয়ে চিন্তিত হলেও তাদের কাজের পরিবেশ ও গুনগত মান নিয়ে তেমন একটা চিন্তিত ছিল না কখনোই। একটা লম্বা ঘরে খুপড়ির মত ছোট ছোট জানালা আর টেবিলে সেলাই মেশিন, বসার জন্য চেয়ার/টুল, মাথার উপরে কয়েকটা ফ্যান আর লাইট থাকলেই হলো। এর থেকে বেশি কিছু তারা কখনই আশা করেনি। একটা অফিসে যে আগুন লাগতে পারে, আর আগুন লাগলে যে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা থাকতেই হবে, সেই সাথে জরুরি নির্গমনের ব্যবস্থা থাকতেই হবে, এসব নিয়ে আমাদের সাধারণ শ্রমিকেরা কখনই মাথা ঘামায়নি। আর বিল্ডিংএর ফাটল নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির কথা ভাবা তো আরো দূরের কথা।
পোশাকশিল্প কিংবা যেকোনো শিল্পেই নিরাপত্তাজনিত ব্যাপারগুলো নিয়ে আমরা সাধারণ জনগণও কখনই মাথা ঘামাইনি। কারণ, এসব দেখার দায়িত্ব মালিকের, সেই সাথে কঠোরভাবে মনিটর করার দায়িত্ব সরকারের। একথা অনস্বীকার্য যে, বিদেশি বায়ারেরা বিভিন্ন সময় আমাদের পোশাকশিল্পের কাজের পরিবেশ উন্নত করা নিয়ে চাপ দিয়ে এসেছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতেরাও এ নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছিলেন।
কিন্তু কোনো সরকারই যে বিষয়গুলো নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়নি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলো সাম্প্রতিক তাজরীন ও রানা প্লাজা ট্রাজেডি। আমাদের দেশের সব সরকার বরাবরই শ্রমিকদের ওপরে মালিকদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। কাজেই পোশাকশিল্পের মালিকদের যেকোনো কুকর্মের দায় অবশ্যই সরকারের ওপরও পড়ে।
সিএনএন’কে সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময় প্রশ্নকর্তার কাছ থেকে যখন জানতে পারি যে, দেশের কয়েক হাজার পোশাকশিল্প কারখানা পরিদর্শন করার জন্য মাত্র ১৮ জন ইন্সপেক্টর আছে, শুনে আমরা অবাক হই। যে দেশে সামান্য একটা অফিস দরকার নেই তারপরও এক পোস্টেরর বিপরীতে ৫/৭ জন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়, সেদেশে লোকবল থাকার পরও কেন এতো কম সংখ্যক ইন্সপেক্টর থাকে তা নিয়ে সিএনএনের পাশাপাশি আমরাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাব চাই।
প্রধানমন্ত্রীর কাছেই আমরা জানতে পারি যে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শ্রমনীতি আইন অনুমোদন করে তা জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। এত বছর পর এতগুলো তাজাপ্রাণের বিনিময়ে অবশেষে শ্রমনীতি পাশ হয়েছে জেনে আনন্দিত হলেও সে নীতি কতখানি বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে শংকা থেকেই যায়।
সাভার ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী রানা যে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদের ছত্রছায়ায় এবং দলের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিল, সাক্ষাত্কারকালে তা প্রধানমন্ত্রী অস্বীকার করলেও সত্য কখনই মিথ্যা হয়ে যাবে না।
তবে প্রধানমন্ত্রী যখন জোর গলায় বলেন, "অপরাধী অপরাধীই। তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। …. সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা তাদের গ্রেপ্তার করেছি। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি ভবনটির মালিক এবং গার্মেন্ট মালিকদের বিরুদ্ধে। " প্রধানমন্ত্রীর এই চটজলদি অ্যকশনে আমরা সত্যি আশার আলো দেখতে পাই।
অপরাধী যে দলেই থাকুক, তাকে অপরাধী হিসেবে আইনের আওতায় আনা হলে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তবে আইনের আওতায় এনে পয়সার জোরে এইসব কুখ্যাত অপরাধীরা পরবর্তী সময়ে ছাড়া পেয়ে বিপুল বিক্রমে ভোটে জয়লাভ করে জনপ্রতিনিধি হয়ে আসবে কি না সে শংকাও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এ কথা সত্য যে, আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও আমিনুল হত্যার তদন্ত কার্যে কোনো অগ্রগতি হয়নি। কেন হয়নি, কার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর তেমন একটা মাথাব্যথা না থাকলেও আন্তর্জাতিক মিডিয়া যে এসব নিয়ে মাথা ঘামায় তা সিএনএন সাক্ষাত্কার থেকেই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
তাই প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে ইচ্ছে করে যে, আমিনুল শ্রমিকনেতা ছিল কি না ছিল, কোন দলের সাথে কাজ করত কি করত না সেটা কিন্তু বড় কথা নয়, বড় কথা হলো আমিনুল নামক একজন শ্রমিক খুন হয়েছে, যার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে চারদিন পর। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবেই কিন্তু আমিনুল ন্যায়বিচার পাবার দাবি রাখে।
প্রধানমন্ত্রীর আমিনুলের ওপর সিমপ্যাথি আছে, এতদিন ধরে মামলা তদন্ত হচ্ছে, এসব দায়সারা গোছের জবাবে প্রতিবেদকের সাথে আমরাও অবাক হয়ে যাই।
তবে আমরা আশ্চর্যান্বিত হই শুনে যে, সাভার ট্র্যাজেডি কাভার করতে সিএনএন এবং অন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়নি! আরো অবাক হই জেনে যে, এ বিষয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি কিছুই জানেন না!!! তবে কি আমরা ধরে নেব যে, প্রধানমন্ত্রীর অন্তরালেই কোনো একটি মহল তাঁর সরকারকে হেয় করার চক্রান্তে লিপ্ত?
নাকি সবকিছু জেনে বুঝেও “আমার দেশ আমি চালাব, যেভাবে খুশি সেভাবে চালাব” এই নীতিতে আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে দূরে রাখা হয়েছিল? তাই যদি হয়, তবে কেন এভাবে সাক্ষাত্কারের নামে অস্বচ্ছ জবাবদিহি করে আমাদের জনগণকে বিব্রত করা হলো? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই জবাব আছে কি আপনার কাছে??
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" বিষয়ে এমএস শেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে বাংলাদেশের "খাদ্যনীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর