মালয়েশিয়া থেকে: সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই ভাবছিলাম আজ রানা প্লাজার উদ্ধার কাজ নিয়ে কিছু লিখব। রানা প্লাজায় ঝাঁকুনি আর ধসের সময় আমি দেশে ছিলাম।
ভাগ্য ভালো যে উদ্ধার কাজে বড় কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। তা হলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের দুর্বলতা পরতে পরতে চোখে পড়েছে। ঘটনার শুরু থেকে উপস্থিত জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে হাত বদল পন্থায় ছোট ও ভঙ্গুর আবর্জনা আশপাশের অন্য কোনো স্থানে স্থানান্তর করা উচিত ছিল। এছাড়া ঘটনাস্থলে যোগ্য কোনো ফরেনসিক দল না থাকায় বিস্মিত হয়েছি।
অনেকেই ভাবছেন আমি আবার কে? কোন যোগ্যতায়, কেন এ সব কথা বলছি? বিএনপি অথবা হেফাজতের কেউ নয় তো!! তাদের অবগতির জন্য বলছি, আমি পেশায় একজন বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট, যার ঝুলিতে রয়েছে ১৯৯৫ সালের জাপানের ‘গ্রেট হান্সিন ভূমিকম্প (কোবে, ওসাকা)’-এর অভিজ্ঞতা। আর আমি কোনো দলবাজ নই।
ভারী যন্ত্র ব্যবহারে বিলম্বিত সিদ্ধান্ত আমাকে অবাক করেছে। কর্তৃপক্ষ যাকে ভারী যন্ত্র বলছেন আমার ধারণায় তার চেয়েও ভারী যন্ত্র আর হেলিকপ্টার ব্যবহার ঘুরপাক খাচ্ছে। এই যদি ভারী যন্ত্রপাতির অবস্থা হয় তাহলে মানতেই হবে যে বিদেশি সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান না করলে অনেকের জীবন হয়ত বাঁচানো যেত।
ঘটনার শুরু থেকেই লিফটিং এর মাধ্যমে উপরের ধংসস্তূপ এবং নিচে হাত বদল পন্থায় ছোট ও ভঙ্গুর আবর্জনা অপসারণে মনযোগী হওয়া উচিত ছিল। শুধুমাত্র সমুদ্রতীরে বহুতল আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেই যদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার শেষ ভাবা যেত, তাহলে আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপর উচ্চতর শিক্ষা অথবা প্রশিক্ষণ কোর্সে আজ কোনো শিক্ষার্থী পাওয়া যেতো না। ভেবে অবাক হতে হয়, যখনই কোনো অঘটন ঘটে তখনি আমাদের দৈন্য প্রকাশ হতে থেকে। জাহাজ ডুবলে উদ্ধারকারী জাহাজের অক্ষমতা, বহুতল ভবনে আগুন লাগলে আধুনিক অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের অভাব যেন নিত্যদিনের ব্যাপার।
সাভারের এই মহা দুর্যোগে যখন দেখি, আর শুনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘নাড়াচাড়া’ তত্ত্ব! রানা প্লাজার মালিক যুবলীগ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক!! যখন শুনি ড্যাবকে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেওয়ার গল্প!!! আর বিরোধী দলীয় নেত্রীর উপস্থিতিতে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হবে তখন বুঝে নিতে কষ্ট হয় না দলবাজি কোন পর্যায়ে চলছে। এসব কি এই দুর্যোগময় মুহূর্তে আলোচনার বিষয় হতে পারে!
সিএনএন-এর ক্রিস্টিয়ান আমানপুরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর ভারতে গিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রী যখন রানা প্লাজার ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করেন তখন দুর্ঘটনার সংজ্ঞাই যেন লজ্জা পায়। দেখা যাক, আমাদের বিশ্বস্ত অক্সফোর্ড ডিকশনারি দুর্ঘটনা বলতে কি বলছে-
১। an unfortunate incident that happens unexpectedly and unintentionally, typically resulting in damage or injury.
২। an event that happens by chance or that is without apparent or deliberate cause.
এই যদি সংজ্ঞা হয়ে থাকে তারপরও কি তারা বলবেন সেটা নিছক দুর্ঘটনা ছিল?
আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রীদের বলা কথার সত্যতাও যদি যাচাই করতে হয় তাহলে তাদের কথা বলার দরকার কি? অবশ্য Vicarious responsibility এর আওতায় প্রধানমন্ত্রী অথবা তার পরিষদের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা এড়াতে তারা যদি এসব কথা বলে থাকেন, তাহলে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
বর্তমান সরকারের আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দৃশ্যমান উন্নতি (হাতিরঝিল, ফ্লাইওভার, রাস্তা, বিদ্যুৎ) তার বিরোধী পক্ষও অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু এর বিপরীতে রানার কীর্তি, বিশ্বজিত খুন, শেয়ার বাজার ধস, পদ্মা সেতু আর হলমার্ক দুর্নীতির পাশাপাশি অফিস পাড়ার দুর্নীতি এতটাই বিস্তার লাভ করেছে যে সরকার তার সুকর্মের কোনো ফল ভোগ করতে পারবে বলে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তার উপর সরকার বিরোধীদের নিপীড়নে সাধারণ মানুষ যে নিপীড়িত হয়েছে তাদের সংখ্যাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
দৃষ্টিকটূ মামলায় জর্জরিত তেতিয়ে থাকা বিরোধী পক্ষ আক্রোশ আর প্রতিশোধের রাজনীতিতে আগামীতে কিভাবে জবাব দেয় সেটা ভেবে শিউরে উঠতে হয়। তবে যে কঠিন সময় সমাগত, আমাদের সেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। আমাদের রাজনীতিবিদরা এ সত্য যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবেন দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
লেখক: অধ্যাপক ও সিনিয়র ফরেনসিক কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারাতে কর্মরত।
ইমেইল: nasimul@salam.uitm.edu.my
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৩