বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এর পাতায় পাতায় শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর তেমন কোনো রকম প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না। কলকারখানায় কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকের মৃত্যু এখন যেন একেবারেই দুধভাতের একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি সাভারের রানা প্লাজায় ভবন ধসে নিহত আমাদের শত শত এই অসহায় শ্রমিকের লাশের পাহাড়কে সামনে রেখে এই প্রশ্নগুলো আমাদের বিবেকের কাছে বার বারই ঘুরে ফিরে আসছে। সেদিন খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, রানা প্লাজার ভবন ধস থেকে বেঁচে আসা নারী শ্রমিকরা জানিয়েছেন তারা কেউই মাতৃত্বকালীন সময়ে কোনরকম ছুটি-ছাটা পেতেন না। তাদের এই বক্তব্যে আমাদের অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। উল্টো আমরা ধরে নিতে পারি যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ গার্মেন্টসে কর্মরত নারীরাই হয়তো এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। একজন শ্রমিক খুব স্বাভাবিকভাবেই তার অধিকার বঞ্চিত হবেন এটাই যেন বর্তমান সময়ে আমাদের জন্য চরম বাস্তবতা। অথচ বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬-এর ৪৫ ধারায় স্বষ্ট বলা হয়েছে যে ‘কোন মালিক তাহার প্রতিষ্ঠানে সজ্ঞানে কোন মহিলাকে তাহার সন্তান প্রসবের অব্যবাহিত পূর্ব ও পরবর্তী আট সপ্তাহ করে মোট ষোল সপ্তাহের মধ্যে কোনো কাজ করাতে পারবে না। ’ হায় আমার শ্রম আইন! আমরা তো জানি যে শ্রমিকের জন্য আইন আছে খাতা-পত্তরে, অফিস আদালতের বড় বড় নথিপত্রে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগটি কোথায়?
আমাদের কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য নতুন কোন ঘটনা নয়। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে শ্রম বাজারে আমাদের নারী শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত এই লিঙ্গ বৈষম্যের করুণ শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের উপস্থিতি ২৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি আমাদের এই নারী শ্রমিকরা যে কোনো ধরনের ঝুকিপূর্ণ কাজ করতে কোনো অংশেই কম নয়। বর্তমান গার্মেন্টস শিল্পে ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের নারী শ্রমিকরা তাদের কর্মক্ষেত্রে এখনও তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। অভিযোগ পাওয়া যায় কারখানার মালিক পক্ষ প্রতিনিয়তই অল্প মজুরি বা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক মজুরিতে আমাদের এই অসহায় নারী শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে বাধ্য করছেন। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৩৪৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, “কোনো শ্রমিকের জন্য কোনো মজুরি নির্ধারণ বা নিম্নতম মজুরির হার স্থিতিকরণের ক্ষেত্রে একই প্রকৃতির বা একই মান বা মূল্যের কাজের জন্য মহিলা এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য সমান মজুরির নীতি অনুসরণ করিতে হইবে, এবং এতদসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে নারী-পুরুষ ভেদের কারণে কোনো বৈষম্য কার যাইবে না। ”
আবারো সেই একই কথা। শ্রমিকদের জন্য আইন আছে কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ করবে কে?
বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশায় শ্রমিকদের সাথে কথা বলে দেখা গেল যে, এদের বেশির ভাগই শ্রম আইন সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। একজন শ্রমিক জানতেও পারেন না যে, শ্রমিক হিসেবে অন্য সবার মতো তারও আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২০০৬-এর ২১৩ ধারা অনুযায়ী যে কোন শ্রমিক তার আইনি অধিকার প্রয়োগের জন্য শ্রম আদালতে দরখাস্ত করতে পারেন। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে শ্রম বাজারে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে ভিন্ন বাস্তবতা! দেখা গেছে, শ্রমবাজারে শ্রমিকের আধিক্য হওয়ার কারণে শ্রমিকরা মালিকদের যে কোনো অন্যায় আবদার চুপ করে মাথা পেতে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। মালিক পক্ষরাও এই সুযোগের পুরোপুরি ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার আদায়ে এগিয়ে আসার জন্যে শ্রমিকদের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে আমাদের শ্রমিকরা যেমন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন পাশাপাশি বিপন্ন হচ্ছে মানবতা এবং মানবতার ইস্পিত পরিবেশ।
সন্দেহ নেই বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ আমাদের শ্রমিকদের রক্ষাকবচ। তবে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ খুব জরুরি। আমরা চাই শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ। একজন শ্রমিক তার প্রাপ্য অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে এই আমাদের প্রত্যাশা। সে জন্য প্রয়োজন মানবিকতা চর্চার মানসিকতা এবং শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা। সরকার পক্ষ, মালিক পক্ষ এবং শ্রমিক পক্ষ তাদের সবাইকে এক সাথেই এই শ্রম আইন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। একজন শ্রমিক আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ এই ধারণাটি আমাদের আত্মায় লালন করতে হবে। সাভারের রানা প্লাজার মতো আরেকটি দুর্ঘটনাও যাতে না ঘটে চলুন সেই লক্ষ্যেকে সামনে রেখে আমরা সবাই একসাথে কাজে নেমে পড়ি। শ্রমিক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে। তাই চলুন শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাই এগিয়ে আসি।
adnansyed1@gmail.com
লেখকঃ অ্যাক্টিভিস্ট, ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) সাথে যুক্ত
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৩
আরআর