ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মুনাফালোভী মালিক ও লাশের মিছিল

মোঃ আতিকুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৯ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৩
মুনাফালোভী মালিক ও লাশের মিছিল

সম্প্রতি তাজরীন গার্মেন্টে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের অকালমৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা, স্পেকট্রাম গার্মেন্ট কারখানা ধসে প্রায় ৩৮ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং স্মার্ট গার্মেন্টে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘রানা প্লাজা’ নামের ত্রুটিপূর্ণ একটি নয়তলা ভবন ধসে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পরে শত শত শ্রমজীবী মানুষের বাঁচার আর্তনাদ। তাদের করুণ মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনায় সমগ্র জাতি আজ স্তব্ধ।

শ্রমিকদের সারি সারি লাশে সাভারের অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের মাঠ এখন যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। স্বজনদের কান্নায় সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।

ভাবতে কষ্ট লাগে, ভবনে ফাটল ও শিল্প পুলিশের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নকশা বহির্ভূত উক্ত ফাটলকৃত ৯ তলা ভবনের চারটি ফ্লোরে ৫টি পোশাক কারখানা নিউ ওয়েভ বটমস লিঃ, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিঃ, ফ্যান্টম ট্যাক লিঃ ও ঈথার টেক্সটাইল লিঃ-এর কাজ শুরু করা হয়। সেদিন কারা দিয়েছিল অই ভবনে পোশাক কারখানাগুলি চালু রাখার অনুমতি। এক রাতের মধ্যেই মুনাফালোভী মালিকরা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে একপ্রকার বাধ্য করে কারখানায় শ্রমিকদের কাজ

তথ্য মতে, ৪ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে ৯ তলা ভবন নির্মাণে স্থানীয় এমপি মুরাদকে ব্যবহার করে ভবন নামের এমন মরণফাঁদ তৈরি করেছিল রানা। যার মর্মান্তিক পরিসমাপ্তি হয় শত শত মানুষের নির্মম অকালমৃত্যুতে। রানাকে এই ধরনের অবৈধকাজে সহযোগিতায় স্বজন হারানো মানুষগুলি পুরো ঘটনার জন্য সমানভাবে দায়ী করছে এমপি মুরাদকে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে এমপি মুরাদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কি না সেটাই এখন দেখার বিষয়।

গত ২০/২১ বছরে অনেক গামের্ন্ট ফ্যাক্টরি ও কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। বহু শ্রমজীবী মানুষের রক্তে ফ্যাক্টরি লাল হয়েছে অথবা পুড়ে ছাই হয়েছে কিন্তু এ থেকে আমরা কি কোন সতর্কতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করেছি? শ্রমজীবী মানুষের কাজের সার্বিক নিরাপত্তা কারখানায় কি এখন পর্যন্ত দিতে সক্ষম হয়েছি? আমরা কি যথাযথ ইমারত নির্মাণের নীতিমালা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ ও পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি? বিপরীতে আমরা সক্ষম হয়েছি এমন জায়গায় কারখানা তৈরি করতে যেখানে অ্যামবুলেন্স অথবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের অনুপযোগী। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, অপরিকল্পিতভাবে যেখানে-সেখানে শিল্প কারখানা তৈরি, ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ এবং মালিকপক্ষের শ্রমিকদের প্রতি উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও মনুষ্যত্বহীন আচরণ এ ধরনের ঘটনার জন্য অধিক দায়ী।

ভাবতে কষ্ট হয় আমরা এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির ক্ষেত্রে এদেশে কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। ফলে এধরনের ঘটনা প্রতিনিয়তই সংগঠিত হচ্ছে। যা থেকে মুক্তি পাওয়া আমাদের একান্ত জরুরি। এজন্য প্রয়োজন শিল্প সংশ্লিষ্ট সকলের শ্রমবান্ধব কাজের পরিবেশ সৃষ্টির সদিচ্ছা। বৈষম্য ভুলে মালিকদের মানুষ হয়ে এইসব হতদরিদ্র্য মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা জাগ্রত করা। মনে রাখতে হবে, শ্রমজীবী এই সব মানুষরাই সকল প্রকার বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের রক্তকে পানি করে দেশের অর্থনৈতিক ভীতকে করছে মজবুত। য‍ৎসামান্য বেতন-ভাতার বিপরীতে মালিকদের গড়ে দিচ্ছে টাকার পাহাড়। দেশের প্রবৃদ্ধি আনয়নে যারা রাখছে বড় অবদান, তাদের জন্য কি সংশ্লিষ্টদের তথা সরকারের তরফ থেকে কিছুই করার নেই? যে পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট অবদান কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত এই শিল্পের মানোন্নয়নে যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই শিল্প সংশ্লিষ্ট আলাদা কোন মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারিনি। এই বিবেকবোধটুকু সকলের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। যদিও মালিকরা শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দুবেলা দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে এ কথা ঠিক। তবে মালিকরা যদি শ্রমিকদের প্রতি আরো একটু উদার ও সদয় হয়ে উপযুক্ত শ্রমবান্ধব কাজের পরিবেশ সৃষ্টি এবং বেতন দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে মালিক শ্রমিকের মধ্যে অধিক বৈষম্য রোধ করতে সক্ষম হয় তবে এর সুফল মনে হয় মালিকরাই বেশি ভোগ করতে পারবে।

যদিও আমাদের এই ঢাকা শহর বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরীর শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। যাকে অনেকে মৃত্যুপুরী নামেও অভিহিত করেন। ঘনবসতিপূর্ণ এই ক্ষুদ্র ঢাকা শহরে প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষের বসবাস। অপরিকল্পিত নগরায়ন হওয়ায় যেখানে সেখানে নিয়ম বর্হিভূতভাবে গড়ে উঠছে অবৈধ বড় বড় ইমারত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শহরের আনাচে কানাচে অপরিকল্পিতভাবে শতশত গামের্ন্ট ফ্যাক্টরি ও শিল্প কারখানা তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো যথাযথ আইন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও শ্রম আইন এর নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে উপরওয়ালাদের ম্যানেজ করে অবৈধ্য অনুমোদন গ্রহণের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে। সেসব কারখানার অধিকাংশতেই নেই শ্রমজীবী মানুষের শ্রমবান্ধব কাজের উপযুক্ত পরিবেশ। ফলে তাতে সেকোন সময়ই ঘটতে পারে এরচেয়ে বড় ধরনের ভয়াবহ হতাহতের ঘটনা। তাই আমাদের আর বসে থাকলে চলবে না, এসব ঘটনা কীভাবে দ্রুততার সাথে প্রতিহত করা যায় এবং এসব অনিয়ম থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করা যায় তার জন্য সকলকে সচেষ্ট হতে হবে এবং এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। শুধু যখন কোন ঘটনা ঘটে তখন ঐ ঘটনাকে নিতে তৎপর ও হৈচৈই না করে গুরুত্ব বুঝে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে উক্ত সমস্যাগুলি সমাধানে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। যে কোন ভুলের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং নিজেদেরকে শুদ্ধি বা সংশোধন করতে হবে। আর তা যদি আমরা করতে না পারি তবে এর  পরিণতি হবে দেশে ও জাতির জন্য সত্যিকারের ভয়াবহ ও বিভীষিকাময়।

আমরা চাই প্রতিটি কারখানায় শ্রমজীবী মানুষের দাবি এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের সার্বিক নিরাপত্তা সর্বোপরি ‘লেবার ল’ নিশ্চিত হোক। মালিকপক্ষ বা কারখানার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন উদাসীনতার কারণে আর যেন কোন শ্রমিককে প্রাণ দিতে না হয়। কারখানার অবকাঠামোগত ক্রটি, শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে আর যেন কাউকে এমন মৃত্যুর মুখে পতিত হতে না হয়। সে ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সরকার, বিজিএমইএ ও মালিকপক্ষ উভয়কে আরো অধিক সচেষ্ট হতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শ্রমিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ‘লেবার ল’ এর আলোকে শক্তিশালী দক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে হবে। যেকোন কারখানা পরিচালনার আগে তা পরিবেশবান্ধব কিনা, শ্রমজীবী মানুষের জন্য উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং যেকোন ধরনের বিপদ থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা বিষয়গুলি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে।

তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের একটি ভুল সিদ্ধান্তে কোনো প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেলে সেই প্রতিষ্ঠান যেকোনো সময় কেড়ে নিতে পারে শত শত মানুষের প্রাণ।

বর্হিবিশ্বে এই শিল্পকে ঘিরে বর্তমানে যে গুঞ্জন চলছে তা যথাযথ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করতে হবে। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে বিশ্বমন্দার সময় সম্ভাবনাময়ী এই পোশাক শিল্পটি আমাদের দেশের অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে এবং প্রবৃদ্ধি আনয়নে যে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে তা যেন কিছু ভুলের কারণে বিনষ্ট না হয়।

লেখক: লাইব্রেরিয়ান ও কলাম লেখক, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি(বিইউএফটি)

বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, ০৫ মে ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।