গতমাসে হেফাজতে ইসলামের লংমার্চের আগে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের আলোচনার কট্টর সমালোচনা করেছিলেন মহাজোট সরকারের দু’জন সাংসদ।
এরা হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ ও মহাজোটের অন্যতম শরিকদল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
জনাব মেননের ‘আম-ছালা’ তত্ত্বমতে সরকার এক দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, আবার অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ব্ল্যাসফেমি আইন নিয়ে কথা বলছেন। আর সরকারের এই দুই নীতির ফলে জনগণও একবার এদিক যাচ্ছে, আবার ওদিক যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, “জনগণ আতঙ্কিত হয়ে গেলে সরকারের আমও যাবে, ছালাও যাবে। ”
ঠিক এক মাস পর মেননের ‘আম-ছালা’ তত্ত্বের বিচারে যদি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদলের বর্তমান কর্মকাণ্ড আজ বিশ্লেষণ করি তবে আমরা এই ‘আম-ছালা’ তত্ত্বের কার্যকরিতা উপলব্ধি করতে পারব।
আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে হেফাজতে ইসলামের অবরোধ ও অবস্থান ধর্মঘট কঠোরভাবে মোকাবেলা করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে গত তিন মাস ধরে শাহবাগে যে আন্দোলন চলছিল তা ভেঙে দিয়েছে।
সরকার এর আগে হেফাজতের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জন ব্লগারকে আটক করেও হেফাজতের সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিল। সেই সমঝোতা যে ব্যর্থ হয়েছে তা আমরা হেফাজতের পূর্বঘোষিত কর্মসূচিতে অনড় থাকা থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। এখন হেফাজতের দাবি-দাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিয়ে সরকার আসলে হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোকে পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দিয়ে হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকার কতখানি সমঝোতায় পৌঁছুতে পারবে, তা আগামী দিনগুলোই বলে দেবে।
অন্যদিকে, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, আমারদেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ এবং দৈনিকটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে, হেফাজতে ইসলামকে ছত্রভঙ্গ করে সরকার গণজাগরণ মঞ্চের দাবি পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে।
গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সমঝোতার উদ্দেশে সরকার কতখানি সক্ষম হবে সেটাও আগামী দিনগুলোই বলে দেবে।
তবে, ব্লগারদেরকে ঢালাওভাবে নাস্তিক খেতাব দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ব্লগার গ্রেফতার, শুরুতে তুমুল সমর্থন দেবার পর হঠাৎ করেই শাহবাগের প্রতি সুনজর তুলে নিয়ে বৈরীভাবাপন্ন হওয়া এবং অতপর গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের ওপর যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা রুষ্ট হবে তা বলাবাহুল্য।
অন্যদিকে, ইসলামকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা হেফাজতকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা মোকাবেলা করে, তাদের সমর্থিত মিডিয়া প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ বাকশালী তকমার সাথে ইসলাম বিরোধী দল হিসেবে সমালোচিত হবে তা সহজেই অনুমেয়।
একদিকে হেফাজতকে মোকাবেলা করতে গিয়ে ইসলাম বিরোধী ও বাকশালী দল হিসেবে অন্যদিকে হেফাজতকে শুরুতে আস্কারা দিয়ে এত সংগঠিত হবার জন্য পরোক্ষভাবে মদদ দেয়া, তরুণপ্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত দেওয়ায় তরুণ প্রজন্মদের কাছেও আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা কমার প্রবল সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এখন জনাব মেননের ‘আম-ছালা’ তত্ত্বে যদি ফিরে যাই, তবে দু’পক্ষের দাবি-দাওয়ার সাথে সরকারের ভারসাম্য রক্ষার নীতি, দু’পক্ষ থেকেই সহানুভূতি উইথড্র আমরা দেখতে পারি। ‘মাথা ব্যথা করছে, কাজেই ওষুধে যখন কাজ হচ্ছে না, তখন মাথা কেটে ফেলাই হলো সর্বশেষ চিকিত্সা’, এই পলিসি কি আদৌ আওয়ামী লীগের ‘আম-ছালা’ রক্ষা করতে পারবে?
এবার দেখা যাক ‘আম-ছালা’ তত্ত্বটি প্রধান বিরোধীদলের ওপরও খাটে কি না।
একথা অনস্বীকার্য যে, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি বিএনপি সমর্থন জানায়নি। নিজের দলের যুদ্ধাপরাধী এবং সেইসাথে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে জামায়াতকে সাথে নেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী তরুণপ্রজন্ম বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কখনই ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি।
তারপরও আওয়ামী রাজনীতি যাদের ভীষণভাবে অপছন্দ, আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনে যারা ভুক্তভোগী তারা ‘নাই মামার থেকে কানা মামা ভালো’ প্রবচনের ওপর ভিত্তি করে বিএনপিকেই সমর্থন জানিয়ে আসছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই রাজনীতির অঙ্গনে নতুন সংযোজন হেফাজতকে দেখে বিএনপি-জামায়াত এমনকি জনাব এরশাদও ভীষণভাবে আস্তিক হয়ে উঠলে, বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে, বিরোধী দলগুলো হেফাজতকেই সরকার হঠানোর অস্ত্র ও নিজেদের ক্ষমতায় যাবার চেরাগ পাবার মতো দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল।
কে কত ধার্মিক, ইসলামের সেবক, ব্লগারদের ঘৃণাকারী, সে বিষয়ে যেন ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশে। হেফাজতের পেটের হেফাজতের জন্য নিজেদের পার্টির তহবিল থেকে খানাপিনার ব্যবস্থা করতেও কোনো দলই বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি।
হেফাজতের অবরোধের পরিকল্পনা জেনে বিএনপির দলনেতা যে ৪৮ ঘণ্টার সরকার হটাও আলটিমেটাম দিয়েছেন সে কথা রাজনীতির সাথে বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই সেই ব্যক্তিও বুঝতে সক্ষম হবেন।
এখন আওয়ামী লীগ কর্তৃক হেফাজতের ছত্র ভঙ্গে বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম যদি বিফলে যায়, তবে কি বিএনপির ‘আম ও ছালা’ রক্ষা পাবে?
আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের ‘আম-ছালা’ রক্ষা তথা ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশলে আমাদের ‘আম-জনতার’ জান বের হয়ে যাচ্ছে, আঁটি হয়ে আমরা ধুলায় মিশে যাচ্ছি দিন দিন। এই মৃতপ্রায় ‘আম-জনতার’ ভোটেই যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলের আসল ‘আম-ছালা’ রক্ষা পাবে, সে খবর কি তারা আদৌ রাখেন?
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" বিষয়ে এমএস শেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে বাংলাদেশের "খাদ্যনীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৫ ঘণ্টা, মে ০৬, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর