কানাডা থেকে: খারাপ খবর দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে মনটা সব সময় খারাপ থাকে। দেশের বাইরে থাকলে দেশের অস্তিত্ব আরো বেশি করে নাড়া দেয়।
অনেক দিন পর তিনটি খবরে মনটা আনন্দের ভরে গেলো। সদ্য প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ভালো ফলাফল, ধ্বংসস্তূপ থেকে সতেরো দিন পরও রেশমার বিস্ময়কর বেঁচে থাকা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধে অপরাধী আলবদর কামরুজ্জামানের ফাঁসির রায়।
আমার জন্মস্থান শেরপুর। সেই শেরপুরের আলবদর নেতা কুখ্যাত কামরুজ্জামান। আর শেরপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আমার নানা মাওলানা ইউসুফ মিয়া। যিনি ছিলেন সাংবাদিক খন্দকার আব্দুল হামিদ, কূটনীতিবিদ সৈয়দ সুলতানদের শিক্ষক। কিন্তু তিনি ‘শান্তি’র জন্যই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন; ছেলেমেয়ে, মেয়ের জামাইদের নিষেধ উপেক্ষা করে।
১৯৭১ সালে আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমার গ্রামের বাড়ি ছিল চরাঞ্চলের মুক্ত এলাকা। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচরণ ছিল অবাধ। সেই সময় আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে শেরপুর শহরে গিয়েছিলাম। তখন নিজ চোখে দেখেছি, শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল হান্নানের মাথা ন্যাড়া করে আলকাতরা মেখে, জুতার মালা পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়ে চাবুক পেটা করেছে।
আদালতে কামরুজ্জামান এই নির্যাতনের কথা অস্বীকার করতে চেয়েছেন। তাহলে কি আমি সেই ‘দৃশ্য’ সেদিন ভুল দেখেছিলাম?
কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনা সাতটি অভিযোগ হলোঃ ১. একাত্তরের ২৯ জুন তাঁর নেতৃত্বে আলবদররা শেরপুরের ঝিনাইগাতি থানার রামনগর গ্রামের বদিউজ্জামানকে অপহরণ ও নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে। ২. কামারুজ্জামান ও তাঁর সহযোগীরা শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে প্রায় নগ্ন করে শহরের রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটাতে চাবুকপেটা করেন। ৩. ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায় ও নারীদের ধর্ষণ করে। ৪. কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গুলি করে শেরপুরের গোলাম মোস্তফাকে হত্যা ও আবুল কাসেমকে আহত করে। ৫. মুক্তিযুদ্ধকালে কামারুজ্জামান ও সহযোগীরা শেরপুরের লিয়াকত আলী ও মুজিবুর রহমান পানুকে অপহরণ ও নির্যাতন করে। ৬. একাত্তরের নভেম্বরে কামারুজ্জামানের নির্দেশে আলবদররা টুনু ও জাহাঙ্গীরকে আটকের পর নির্যাতন করে এবং টুনুকে হত্যা করা হয়। ৭. কামারুজ্জামান ও আলবদরের সদস্যরা ছয়জনকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
আলবদরের নেতা কামারুজ্জামান ছিল আমার নানার ডান হাত। শুধু তাই নয়, শেরপুর, জামালপুর এবং ময়মনসিংহে তিন শহরেরই কামারুজ্জামানের ‘রাজত্ব’ ছিল। তার জন্য সোহাগপুর গ্রাম ‘বিধবা’ গ্রামে পরিণত হয়েছিল।
আমার নানার মৃত্যুর পর আমি ভোরের কাগজে একটি লেখা লিখি। যা ছাপা হয় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সালে। পরে লেখাটি মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ফরিদ কবিরের সম্পাদনায় ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে স্থান পায়। কড়া ভাষায় লেখাটিতে কামারুজ্জামানদের কথা উল্লেখ থাকায়, জামায়াতের এই নেতা আমাকে শেরপুর জেলায় নিষিদ্ধ ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আজ ৪২ বছর পর হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক জনের ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু যদি তা দ্রুত কার্যকরী না হয়, তাহলে তা হবে খুবই বিপজ্জনক। কামারুজ্জামানদের রায়ের দিন সেই ইঙ্গিত দিয়ে তার আইনজীবী বলেছেন, সরকার বদল হলে এই রায়ও বদল হয়ে যাবে।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইস্তেহারে যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তা পূর্ণাজ্ঞ বাস্তবায়ন না করলে সরকারের জন্যও বিপজ্জনক। কারণ, সরকারের মেয়াদ আর মাত্র কয়েক মাস আছে। এই কয়েক মাসে কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করবেন, তা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কাজেই, যাদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে, তা দ্রুত কার্যকর করা একান্ত বাঞ্ছনীয়।
saifullahdulal@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৩ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৩
আরআর