ঢাকা: বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বড় ‘গুণ’- বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরিতে আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য চমৎকার সব পোশাক তৈরি করে দিতে পারেন এখানকার দক্ষ শ্রমিকরা। যে কারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডও পোশাক তৈরির জন্য বাংলাদেশকেই আগে বেছে নেয়।
জো ফ্রেশ, ম্যাঙ্গো, বেনেটনের মতো খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করার প্রমাণ মিলেছে সাভারের ধসে পড়া ভবন রানা প্লাজায়। এসব ব্র্যান্ডের ফেসবুক পেজে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। শুধু তাই নয়, রাস্তায় রাস্তায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল, লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্কে গ্যাপসহ কয়েকটি খুচরা বিক্রেতার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ করছে বিভিন্ন শ্রম সংগঠন।
পরিস্থিতি থেকে যা বোঝা যাচ্ছে, পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর জন্য এখন দু’টি পথ খোলা আছে- বাংলাদেশে উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও কাজের পরিবেশ উন্নত করা, অথবা বাংলাদেশ ত্যাগ করে বেশি খরচে বাংলাদেশিদের সমান বা কম দক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো। অবশ্য দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একটি দরিদ্র দেশকে বঞ্চিত করার জন্য সমালোচনারও মুখোমুখি হতে হবে ব্র্যান্ডগুলোকে।
তবে বেশিরভাগ খুচরা বিক্রেতাই বাংলাদেশে ত্যাগ না করে এখানকার কাজের পরিবেশ পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদনকারী দুই শীর্ষ কোম্পানি ওয়ালমার্ট ও এইচঅ্যান্ডএম জানিয়েছে, বাংলাদেশকে ত্যাগ করার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের। চিলড্রেন’স প্লেস, ম্যাঙ্গো, জে.সি. পেনি, বেনেটন, গ্যাপ, সিয়ার্সও একই মত দিয়েছে।
তবে কোনো কোনো কোম্পানি মনে করছে, বাংলাদেশে কাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওয়াল্ট ডিজনি এদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে আর উৎপাদন চালিয়ে যাবে না বলে চলতি মাসেই তারা ঘোষণা দিয়েছে। ডিজনির কনজ্যুমার প্রোডাক্টস বিভাগের প্রেসিডেন্ট বব চ্যাপেক এ ব্যাপারে সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেন, “এগুলো জটিল ধরনের বৈশ্বিক সমস্যা, এর কোনো সুনির্দিষ্ট সহজ সমাধান নেই। ”
শিল্প বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরোপুরি ছেড়ে না গেলেও বাংলাদেশের উপর থেকে নির্ভরতা কমাতে থাকবে কোম্পানিগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে যেসব খুচরা বিক্রেতারা পোশাক তৈরি করছে, ইচ্ছা করলেই তাদের জন্য দেশত্যাগ করা সহজ নয়।
বিশ্বজুড়ে সস্তা শ্রম বা উপযুক্ত কারখানার অভাব নেই বটে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে বিপুলপরিমাণ পোশাক তৈরির জন্য যে আস্থা ও সম্পর্ক প্রয়োজন, নতুন দেশে নতুন কারখানায় তা অর্জন করতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, সস্তা শ্রমের অন্য দেশগুলোতেও কোম্পানিগুলোর একই ধরনের ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে।
যুক্তরাজ্যের ঝুঁকি বিশ্লেষক সংস্থা ম্যাপলক্রফটের মতে, শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কাজের পরিবেশই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে কম মজুরির দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে, যেমন- শিশু শ্রম, জোরপূর্বক শ্রম ইত্যাদি। সংস্থাটি তাদের শ্রম অধিকার ও নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশকে ১৭তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের আগে রয়েছে চীন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত। অর্থাৎ এসব দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
আরেকটি কারণে ব্র্যান্ডগুলোর বাংলাদেশ ত্যাগ করা কঠিন। তাদের চাহিদা হলো বেশি পণ্য, কম দাম, ভালো মান ও সঠিক সেবা। এসব চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত শ্রমিক, উৎপাদন ক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা অল্প যে কয়েকটি দেশের রয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
এছাড়া পোশাক উৎপাদনের মোট পাইকারী খরচের ১৫ থেকে ২০ ভাগই মজুরি খরচ। যেহেতু কাঁচামালের খরচ তেমন পরিবর্তিত হয় না, তাই উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু মজুরির উপরই নির্ভর করতে হয় খুচরা বিক্রেতাদের। আর এ খরচ বাংলাদেশেই সর্বনিম্ন হওয়ায় এখানে ঝুঁকে পড়েছে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো, যার কল্যাণে দ্রুত এই খাতের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ, যার অবস্থান চীনের পরেই। দেশে বর্তমানে ৫ হাজার পোশাক কারখানা রয়েছে, যাতে ৩৬ লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত।
কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম অধিকার ফোরামের মতে, ২০০৫ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসে পড়ায় ১৮শ’রও বেশি শ্রমিকের প্রাণহানি হয়েছে।
২০১২ সালের নভেম্বরে সাভারের তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিক নিহত হয়। ডিজনি, ওয়াল-মার্ট ও সিয়ার্সের পোশাক তৈরি হওয়ার প্রমাণ মিলেছিল পুড়ে যাওয়া ভবনের ধ্বংসাবশেষে।
এরপর গত ২৪ এপ্রিল ঘটে দেশের গার্মেন্টস ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। সাভারের আটতলা বাণিজ্যিক ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ে, যাতে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল।
এর উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার আগেই গত বুধবার ঢাকায় আরেকটি সোয়েটার কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, যাতে কারখানা মালিকসহ আটজন নিহত হন।
রানা প্লাজায় যেসব কোম্পানির কোম্পানির পোশাক তৈরি হতো, তাদের মধ্যে শুধু ব্রিটেনের প্রাইমার্ক ও কানাডার জো ফ্রেশ ওই ভবনের কারখানায় তাদের পোশাক তৈরি হতো বলে স্বীকার করেছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে। ইতালিয়ান ব্র্যান্ড বেনেটন স্বীকার করেছে যে তারা সেখান থেকে একবার কাজ করিয়েছে। স্পেনের প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গোর নথিপত্র ধ্বংসস্তূপে পাওয়া গেলেও তারা দাবি করেছে, ওই ভবনের কারখানা থেকে তাদের কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু তখন পর্যন্ত কাজ শুরু হয়নি।
এদিকে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোকে পশ্চিমের সমান মানসম্পন্ন করার জন্য কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা নিয়ে চলছে হিসাব-নিকাশ। ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়ামের মতে, এর পরিমাণ দেড়শ’ থেকে তিনশ’ কোটি ডলার। আর এই অর্থ যদি পাঁচ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে কাজে লাগানো হয়, তাহলে তা হবে এই সময়ে এই খাতে বিনিয়োগ করা অর্থের (সাড়ে নয় হাজার কোটি ডলার) দেড় থেকে তিন শতাংশ।
ওয়ালমার্ট, এইচঅ্যান্ডএম, জে.সি. পেনিসহ বিশ্বের ৪০টি পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গত ২৯ এপ্রিল শ্রম অধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের নিরাপত্তা নিয়ে বৈঠক করেছে। এ সংক্রান্ত একটি সম্মিলিত আইনি প্রচেষ্টায় সই করার জন্য ব্র্যান্ডগুলোকে চাপ দিচ্ছে শ্রম সংস্থাগুলো। আগামী বুধবার এ চুক্তিতে সই করার শেষদিন। কেলভিন ক্লাইন, টমি হিলফিগারের মালিক প্রতিষ্ঠান পিভিএইচ এবং জার্মান খুচরা বিক্রেতা টিশিবো ইতোমধ্যে এ চুক্তিতে সই করেছে। গ্যাপের সই করার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তারা পিছিয়ে গেছে। তবে অন্যান্য ব্র্যান্ডকেও এতে সই করার জন্য চাপ দিচ্ছে শ্রম সংগঠনগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলোর একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকারেরও এগিয়ে এসে তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করা উচিত। নইলে ধীরে ধীরে আরও অনেক কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৩
আরআর