ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সজল খালেদঃ আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ

ইবনুল করিম রূপেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০০০ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৩
সজল খালেদঃ আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ

প্রায় সাত বছর আগে সজল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। লিরিক নামে একটি গানের কাগজ প্রকাশ করতাম আমরা বন্ধুরা।

শিল্পী স্বপন চৌধুরীর বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতাম লিরিকের কাজে। একদিন স্বপন’দা আমাকে ডেকে বললেন যে উনি একটি এক্সিবিশন করবেন গ্যালারি চিত্রকে; ওনার পেইন্টিং আর সজল নামে ওনার এক ছাত্রের ফটোগ্রাফি। সজল ভাই অনেক দিন পর দেশে এসেছেন। এক্সিবিশনের বিভিন্ন কাজে আমি যেন তাকে সাহায্য করি।

কাজ শুরু করলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক গল্প করতাম দু’জন। একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম এই লোকটার দেশপ্রেমের গভীরতা অসীম। লিরিকের আদ্যোপান্ত জানতে চাইতেন। দেশে ফিরেই সজল ভাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে তাঁর ডকুমেন্টারি ফিল্ম “একাত্তরের শব্দসেনা”র কাজ শুরু করেন। ফিল্ম নিয়ে কথা হতো প্রতিদিন। মাঝে মাঝে আমাকে শ্যুটিং-এ নিয়ে যেতেন। কতবার তাঁর মগবাজার এর বাসার চিলেকোঠায় আড্ডা দিয়ছি তাঁর হিসেব নেই। লিরিকের একটি সংখ্যা করেছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে। যা সজল ভাইয়ের সাহায্য ছাড়া কখনো সম্ভব হতো না। ওই সংখ্যায় তাঁর একটা ইন্টারভিউও করেছিলাম আমি।
 
আমি যতবার তাঁর সামনে যেতাম এক ধরনের জড়তা অনুভব করতাম। এর একটাই কারণ, সজল ভাই’র বিনয়। এত অল্প স্বরে তিনি কথা বলতেন আর সবাইকে এত সম্মান দিয়ে কথা বলতেন যে নিজেকে তাঁর সামনে অত্যন্ত বেমানান মনে হতো।

তাঁর এই বিনয় আর সততার সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাঁকে ঠকিয়েছেন বহুবার। দু’একটি উদাহরণ না দিলেই না। একটি স্টিল কোম্পানির ব্রুসিয়ারের কাজ করলাম আমি আর সজল ভাই। সব কাজ শেষ হওয়ার পর পেমেন্ট করলো না সেই কোম্পানি। তাঁর বানানো ‘একাত্তরের শব্দসেনা’ বিক্রি হয়ে গিয়েছিলো তাঁর অজান্তেই! সজল ভাই কষ্ট পেয়েছিলেন। তাঁর সেই চেহারাটা এখনো আমার সামনে ভেসে ওঠে, আর আমার চোখ ভিজে আসে। আর একটা বড় উদাহরণ দিই। পর্বতারোহণ নিয়ে অনেক লেখা লিখতেন সজল ভাই। বর্তমানের এক সেলিব্রিটি পর্বতারোহীকে তিনি তাঁর লেখাগুলো দিতেন শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকে ছাপাবে বলে। সেই সেলিব্রিটি পর্বতারোহী কয়েকটি লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিলেন।

দারুণ সব বিজনেস আইডিয়া নিয়ে প্রোজেক্ট পেপার তৈরি করেছিলেন সজল ভাই। ঢাকা শহরের ময়লা আবর্জনা রিসাইকেল করা, কুমির আর চন্দন কাঠের ফার্ম, বিদেশগমনে ইচ্ছুক নিরক্ষর মানুষদের ট্রেনিং দেওয়া... আরও কত কি! সবগুলোতেই সঙ্গে রাখতে চাইতেন আমাকে। এর কোনোটা হয়তো বাস্তবায়ন হতো, যদি এভারেস্ট বিজয়ী সজল খালেদ দেশে ফিরতেন।

বিএমটিসি আর এক্সট্রিমিস্ট ক্লাবের হয়ে কত কিছু আয়োজন করেছেন তিনি। ঘুড়ি উৎসব, ম্যারাথন, রমনা পার্ক পরিষ্কার করা, সাইক্লিং আরও কত কি!

গত ডিসেম্বরে আমি দেশের বাইরে ছিলাম। সজল ভাই আমাকে ফেসবুকে নক করে বললেন, “রূপেন, আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসেন। কাজলের দিনরাত্রি’র প্রিমিয়ার ২৯ তারিখ। আপনার আর মুনমুনের অনেক কাজ। “ এই মুভির শুরুর দিকের বেশ কিছু কাজ করেছিলাম আমি আর মুনমুন। এর কিছু শ্যুটিং আমাদের অফিসেও হয়েছিলো।

আমি আর আমার স্ত্রী মুনমুন অনেকবার সজল ভাইয়ের বাসায় গিয়েছি। এইতো সেদিন, সুস্মিতের প্রথম জন্মদিনে কত মজা করলাম আমরা। এভারেস্টে রওনা হবার ২/৩ দিন আগে আমার অফিসে এসেছিলেন বিদায় নিতে। এটাই আমার সজল ভাইর সঙ্গে শেষ দেখা।

সজল ভাই, মনে মনে খুব বকছি আপনাকে, গালি দিচ্ছি, আর একটু পরপর কেঁদে উঠছি। কেন গেলেন আপনি এভারেস্টে! কী আছে ওখানে!  কখনো কারও উপর রাগ করতে দেখিনি আপনাকে। উচ্চ গলায় কথা বলতে শুনিনি। তাহলে এত সাহস কেন আপনার! এইটুকু জীবনে আমার দেখা সবচাইতে ভালো মানুষ আপনি, বুকে হাত রেখে বলছি। আমি আর মুনমুন খুব কাঁদছি সজল ভাই, খুব কাঁদাচ্ছেন আপনি... খুব বকছি আপনাকে...। পর্বত ছিল আপনার অনেক বেশি প্রিয়। আর সেই পর্বতের ডাকে ছুটে গেলেন আপনি।

• লেখক- এক্সিকিউটিভ,কনটেন্ট অ্যান্ড ডিজিটাল মার্কেটিং, রিভ সিস্টেমস

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৫ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।