ঢাকা: আমাদের মহাকাব্যিক স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি হানাদারদের পাশাপাশি নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছিল এদেশের স্বাধীনতাকামী সর্বস্তরের মানুষের ওপর।
জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’-এর (বর্তমানে ইসলামী ছাত্রশিবির) নেতাকর্মী, আল-বদর নিয়ে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের নেতাকর্মীদের নিয়ে আল-শামস এবং ঊর্দুভাষী বিহারিদের নিয়ে আল-মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালে এই সব বাহিনী সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল। এসবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নেতারা।
এ বছরের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষণার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
পরে ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৮ ফেব্রুয়ারি নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। এই মাসের ১০ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ জামায়াতে ইসলামীর আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যু দণ্ডাদেশ দেন।
বৈশিষ্ট্যগত বিচারে মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ঘোষণাকৃত আগের তিনটি রায় থেকে আলাদা।
এই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি বা নেতৃত্বের দায় ডকট্রিনের বিষয়টি আমলে নিলেন।
ট্রাইব্যুনাল-২ বলেছেন যে, কামারুজ্জামান তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন। এই সময় আল-বদর বাহিনী ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় বিভীষিকাময় মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। তাই, আল-বদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে নৃশংস কর্মকাণ্ডের দায় কামারুজ্জামান এড়াতে পারেন না।
এখানে উল্লেখ্য যে, ট্রাইব্যুনাল সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির জন্য কামারুজ্জামানকে আলাদা কোনো শাস্তি দেননি। কারণ, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা নেতৃত্বের দায় বিষয়টিকে অভিযোগে আনেননি (সূত্র: ডেইলি স্টার অনলাইন/ ১০ মে, ২০১৩)। কিন্তু, ট্রাইব্যুনাল সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির বিষয়টিকে যে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
শুধু জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামান একাই নন, জামায়াতের ইসলামের উচ্চ পর্যায়ের প্রায় সব নেতাই ১৯৭১ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যাসহ সব ধরনের নৃশংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। ইতোমধ্যে, কিছু নেতার বিচার ট্রাইব্যুনালে চলমান ও অনেকেরই বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পথে।
তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধেই সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি বা নেতৃত্বের দায়ের অভিযোগটি আনা হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কথাবার্তা থেকে অনুমেয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের প্রাক্তন আমির গোলাম আজম, যিনি মধ্যমণি হিসেবে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি বা নেতৃত্বের দায়ের অভিযোগটি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. তুরিন আফরোজ আশা করছেন যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত (সূত্র: অনলাইন ভোরের কাগজ/ ১১ মে, ২০১৩)। তবে জনমনে একটা আশঙ্কা আছে, গোলাম আযমের বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও ড. তুরিন আফরোজ এ আশঙ্কাকে বিবেচনায় নিচ্ছেন না।
জামায়াতের আরেক ‘বিগফিশ’ মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল-১ এর সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান। নিজামী ১৯৭১ সালে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ৭১ সালে যুদ্ধ চলাকালীনই সমগ্র পাকিস্তানের সভাপতি নির্বাচিত হন।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার একই ট্রাইব্যুনালে চলছে। ইতোমধ্যে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উপস্থাপন করছেন। মুজাহিদ ১৯৭১ সালে প্রথম ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি এবং পরে একই বছরে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পান।
মূলত জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্বের প্রায় সবাই, একাত্তরের পতাকা অর্জনের সংগ্রামে শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতাই করেননি, বিভিন্ন বাহিনী গঠন করে এই দেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়ক শক্তি হিসেবে।
এইসব বাহিনী দেশের অসহায় মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছে, নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে, তাদের তুলে দিয়েছে পাকি সেনাদের হাতে, জ্বালিয়ে দিয়েছে গ্রাম-শহর ও লুট করেছে মানুষের ধন-সম্পদ।
একাত্তরের এইসব অমানবিক নৃশংস কর্মকাণ্ডের জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন নেতারা যে দায়ী, তা ঐতিহাসিকভাবেই প্রমাণিত। এই সবের দায় তারা কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।
তাই, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের যুদ্ধচলাকালীন বিরোধী নেতৃত্বের অভিযোগ উপস্থাপন এখন জামায়াত-শিবিরের জন্য এক নতুন আতঙ্ক।
লেখক:
পিএইচডি গবেষক ও কলাম লেখক
চন্নাম ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়
সাউথ কোরিয়া
ইমেইল: bipoly3001@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, মে ২৪, ২০১৩
সম্পাদনা: তানিম কবির, নিউজরুম এডিটর; আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর, জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর